• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
নৌপথে ঈদযাত্রা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা

ছবি : সংগৃহীত

যোগাযোগ

নৌপথে ঈদযাত্রা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা

# ফেরির সংখ্যা বাড়ানোর সুপারিশ # ফেরি সংকটের শঙ্কা : প্রতিমন্ত্রী # চর এলাকায় বাতি দেওয়ার দাবি # তিন দিন ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পারাপার বন্ধ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২২ জুলাই ২০১৯

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১২ আগস্ট দেশে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ উদযাপিত হতে পারে। এর মাঝে দেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতির জন্য এবার নৌপথে ঈদযাত্রা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল রোববার রাজধানীর আবদুল গণি রোডের বিদ্যুৎ ভবনে ঈদুল আজহা উপলক্ষে নৌপথে যাত্রীদের সুষ্ঠু ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিতে আয়োজিত সভায় এ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। এ ছাড়াও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, নৌযান মালিক-শ্রমিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বরাবরের মতো ঈদের আগের তিন দিন এবং পরের তিন দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও কোরবানির পশুবাহী ট্রাক ছাড়া সাধারণ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ফেরিতে পারাপার বন্ধ থাকবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সভায় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ বলেন, ‘আমরা চাই, ঈদযাত্রা ভালো হোক। কোনো যাত্রায় আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াই, এটা কাম্য নয়। এবারের বন্যার ধরনটা অন্যরকম। এবার গাইবান্ধা শহরের মধ্যে কোমরের ওপর পানি। এটা একটা ব্যতিক্রম বিষয়। নদীর স্রোতের জন্য ফেরি চলতে পারছে না। বিআইডব্লিউটিসি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়ায় আমরা অনেক বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি।’ তিনি বলেন, ‘জীবন বাজি রেখে ঈদযাত্রা করতে হবে-এ ব্যাপারে যাত্রীসাধারণকে বলব, জীবন বাজি রেখে ঈদযাত্রার মাধ্যমে নিজেকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের সক্ষমতা যতটুকু আছে আমরা ততটুকুই সার্ভিস দিতে পারব। নতুন নতুন প্রকল্প নিয়েছি, যখন এগুলো আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে, আমাদের সক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা ও সার্বিক নদীর অবস্থা বিবেচনায় এবার ফেরির ক্ষেত্রে কিছুটা সংকট হওয়ার শঙ্কা আছে।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মলম পার্টির মাধ্যমে কোনো যাত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটার খেসারত অপরাধীদের দিতে হবে। কোনো অপরাধীকে আমরা কখনই ক্ষমা করব না।’

নৌপরিবহন সচিব মো. আবদুস সামাদ বলেন, ‘আমরা বিআইডব্লিউটিসির পক্ষ থেকে শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে সর্বোচ্চ সংখ্যক ফেরি দেওয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু আমাদের ফেরিগুলো পুরনো, ৬০-৭০ বছরের পুরনো ফেরিও আছে।’ তিনি বলেন, ‘এবার বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি মধ্যাঞ্চলে জমা হবে। নদীতে স্রোত তীব্র থাকবে-এটা আমরা ধরে নিতে পারি। পানি আসতেছে, বর্ষা থাকার সম্ভাবনা আছে। কাজেই সেগুলো মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।’ সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থেকে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সচিব বলেন, ‘কোরবানির ঈদে একটা দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদের মহাবিপদ চলে আসবে।’

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর এম মাহবুব-উল ইসলাম বলেন, ‘এবার ঈদে আমাদের ৫০ লাখ যাত্রী এবং প্রায় ৭০ লাখ কোরবানির পশু স্থানান্তর করতে হবে। এটা খুব স্বল্প সময়ে করতে হবে। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।’

বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান প্রণয় কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘তীব্র স্রোতের কারণে শিমুলিয়া, কাঁঠালবাড়ি, পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটছে। আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সামনে ঈদ, এসব ফেরির ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিলে ঈদের আগে মেরামত করা সম্ভব হবে না। এতে ঈদে ফেরি সংকট দেখা দিতে পারে।’

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে মোট ১১টি টার্মিনাল এবং ১১৩টি লঞ্চঘাটের মধ্য দিয়ে সর্বমোট ৮৩২টি যাত্রীবাহী নৌযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ২১০টি পরিচালনা করা হয় দূরপাল্লার গন্তব্যে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন লঞ্চগুলোর মাধ্যমে গড়ে তিন লাখ যাত্রী পরিবাহিত হয়, ঈদের সময় এ যাত্রী প্রায় পাঁচ লাখে উন্নীত হয়।’ মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের সময় অতিরিক্ত লাইফ সেভিং ইক্যুইপমেন্ট রাখার দায়দায়িত্ব লঞ্চ মালিকদের নিতে হবে।’

লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি সহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘নদীপথের চর এলাকায় অতিসত্বর বাতি দিতে হবে, স্রোত যখন নামে তখন লঞ্চও খুব দ্রুত নামে, তখন কোনো কারণে চরে লঞ্চ ঠেকে গেলে তা উল্টে যেতে পারে।’

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘এবার এমন সময়ে ঈদ, আমাদের সামনে যখন ভরা বর্ষা। নদীতে তীব্র পানির স্রোত, এ সময়ে চাঁদপুরে একটা ঘূর্ণিস্রোতের অবস্থা তৈরি হয়েছে। পানির স্রোত এত বেশি, অনেক বড় নৌযানকেও উজানে ঠেলে আসা অত্যন্ত কষ্টকর।’

এ সময়ে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলের প্রধান রুট বিশেষ করে মিয়ারচর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে-জানিয়ে শাহ আলম বলেন, ‘সেখানে একটি কার্গোডুবির ঘটনার পর ওই স্থান দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলছি আমরা। মিয়ারচর এড়িয়ে ছোট নৌযানগুলো কালীগঞ্জ ঘুরে বরিশাল যেতে পারবে না। ঈদ সামনে এসেছে, মিয়ারচর বন্ধের কথা বলা হচ্ছে, বন্ধ হলে আমি কোন জায়গা দিয়ে যাব?’

রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার বলেন, ‘শনিবার রাজবাড়ীতে চার কিলোমিটার যানজট ছিল। ফেরির খুব সংকট এবং প্রচুর সমস্যা। যেখানে ১০-১২টির মতো ফেরি চলে সেখানে দুটি মাত্র আছে, রো রো ফেরি। যার মাধ্যমে বেশি যানবাহন পারাপার করা যায়। আর যেগুলো আছে, ছোট ছোট ফেরি। কিছু ফেরি বসে আছে, তারা স্রোতের প্রতিকূলে যেতে পারে না। কখনো কখনো অপেক্ষমাণ যানবাহনের দৈর্ঘ্য ৬-৭ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে যায়। ফেরি না থাকলে আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। ফেরি বাড়াতেই হবে। ঈদের সময় চাপ খুব বেশি থাকবে।’

মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক বলেন, ‘বৃহস্পতিবারের তথ্যানুযায়ী, ১৬টি ফেরির মধ্যে তিনটি ফেরি চলাচল করতে পেরেছে। স্রোতের কারণে নাব্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে আরেকটি চ্যানেল প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি দৃষ্টিতে আনা উচিত।’

মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বলেন, ‘প্রথমত আমাদের ফেরির সংখ্যা বাড়াতে হবে। গত ঈদুল ফিতরের সময় পাটুরিয়া ঘাটে ২১টি ফেরি চলাচল করেছে। পদ্মা-যমুনার পানির বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে গত ঈদের চেয়ে এবার ফেরি পার হতে দ্বিগুণ সময় লাগবে। ৪০টি ফেরির ব্যবস্থা করা হলে যাত্রী চলাচল নির্বিঘ্ন হবে।’

এ সময় বিভাগীয় কমিশনাররা, সংশ্লিষ্ট পুলিশের ডিআইজি, বিভিন্ন জেলার এসপি, নৌপরিবহন মালিক সমিতির সদস্য ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

নৌ নিরাপত্তায় ১০ দফা সুপারিশ : ঈদুল আজহা উপলক্ষে নৌপথে নিরাপদ যাতায়াতের লক্ষ্যে ১০ দফা সুপারিশ উত্থাপন করেছে শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম (এসসিআরএফ)।

গত শনিবার সংগঠনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই সুপারিশ উত্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ভরা দুর্যোগ মৌসুমে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। এই বিবেচনা থেকে বাস্তবতার আলোকেই সুপারিশগুলো তৈরি করা হয়েছে।

এসসিআরএফের ১০ দফা সুপারিশে রয়েছে- সব নদীবন্দর ও নৌপথে অবিলম্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম শুরু; নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএতে জরুরিভিত্তিতে তিনজন করে অস্থায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদায়ন দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি; পদ্মার শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল সুশৃঙ্খল রাখতে পর্যাপ্তসংখ্যক র্যাব, পুলিশ ও আনসার মোতায়েন; লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বহন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ; উপকূলীয়, হাওর ও পাহাড়ি জনপদে অবৈধ ও ত্রুটিপূর্ণ নৌযান চলাচল বন্ধে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে সম্পৃক্তকরণ; গুরুত্বপূর্ণ নৌপথগুলোতে কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশের তৎপরতা জোরদারকরণ; টার্মিনাল ও গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলোতে বড় পর্দা, লাউড স্পিকার ও বেতার-টেলিভিশনে প্রতি ঘণ্টায় আবহাওয়া বার্তা প্রচার; লঞ্চ ও স্টিমারসহ সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন; সব টার্মিনালে শৌচাগার ও ওজুখানায় পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থাসহ পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণ এবং যাত্রীবোঝাই লঞ্চ ছাড়ার আগমুহূর্তে ভিডিওচিত্র ধারণ করে যথাযথভাবে সংরক্ষণ।

এসসিআরএফের সভাপতি আশীষ কুমার দে বলেন, দূরপাল্লার সড়কে তীব্র যানজটসহ সারা বছর যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তাতে উপকূলীয় জনপদের মানুষ ঈদযাত্রায় নৌপথকেই প্রাধান্য দেবে। ফলে লঞ্চ-স্টিমারসহ নৌযানে যাত্রীর চাপ অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে চলছে ভরা দুর্যোগ মৌসুম। তাই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জনস্বার্থে আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads