• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়

‘দালালমুক্ত পরিবেশে’ মাসে কোটি টাকার ঘুষ-বাণিজ্য

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৯ অক্টোবর ২০১৯

দালাল ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মিরপুর কার্যালয়। যদিও কর্মকর্তা ও পুলিশ-আনসার বাহিনীর সদস্যরা বিআরটিএ আঙিনা ‘দালালমুক্ত পরিবেশ’ বলছে; কিন্তু এর আড়ালেই চলছে শুভংকরের ফাঁকি। অভিযোগ আছে, এ কার্যালয়কে ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একাধিক দালালচক্র। কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশেই এ চক্র গড়ে উঠেছে। আর এ দালালচক্রই নিয়ন্ত্রণ করছে মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়। দালাল-কর্মকর্তারা মিলে প্রতি মাসে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন সাধারণ সেবা প্রার্থীদের কোটি টাকা।

একাধিক সেবাগ্রহীতা অভিযোগ করেছেন, বিআরটিএ কার্যালয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোনো সেবা মেলে না। দালাল ছাড়া কাজ করতে গেলে পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। নানা অজুহাত দেখিয়ে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি করেন কর্মকর্তারা।

তবে কর্মকর্তারা হয়রানি ও দালালদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে যাই বলুক দালালদের সহায়তা ছাড়া মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে সেবা পাওয়া দুষ্কর। সব ধরনের গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও টাকার বিনিময়ে মিলছে লাইসেন্স। এই অসাধ্য কাজটি সম্ভব করেন দালালরা।

জানা যায়, মোটরসাইকেলের লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ব্যাপক বাণিজ্য করছে দালালচক্র। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও চুক্তি করে লাইসেন্স বানিয়ে দেয় দালালরা। বিনিময়ে প্রতি লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। যদিও বাইকের সরকারি লাইসেন্স ফি মাত্র আড়াই হাজার টাকার মতো।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে গাড়ির লাইসেন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মালিকানা হস্তান্তর, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও গাড়ির নিবন্ধনসহ যে কোনো কাগজপত্র সম্পাদন সাধারণ প্রক্রিয়ায় সহজেই সম্পন্ন করতে পারেন না সেবাগ্রহীতারা। নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা বলে মানুষকে দালালদের দিকেই ঝোঁকানো হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের ভেতরে স্টেশনারি দোকানের মালিক-কর্মচারী ও ভ্রাম্যমাণ হকারদের নেতৃত্বে দালাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কার্যালয়ের প্রবেশ গেট, ব্যাংক, বুথ ও বাদামতলায় সর্বত্র দালালরা তৎপর। মূল ফটকের পাশে স্ট্যাম্প, ফটোকপির দোকানগুলো এ দালালদের মূল আস্তানা।

দেখা যায়, মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেট পেতে লাইনে দাঁড়ালে দালালরা তৎপর হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নম্বর প্লেট পেতে অনেকে ভোগান্তি পোহাতে চান না, তাই দালালরা কৌশলে সারির অগ্রভাগে নিয়ে আসেন বাইক। এ সিরিয়াল দেওয়ার নামে প্রতিজনের কাছ থেকে ৪০০ টাকা হাতানো হয়। এছাড়া ডিজিটাল নম্বর প্লেট বসাতে স্টিলের প্লেটটি ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। অথচ এটা ১০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।

সরজমিনে দেখা যায়, বিআরটিএ অফিসের সামনের সড়কে ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। বেশির ভাগই প্রাইভেটকার। এ ছাড়া ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, সিএনজি অটোরিকশাও রয়েছে। নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আসা লোকজনের ভিড় থাকায় দালালদের ছোটাছুটিরও অন্ত নেই।

জানা যায়, কর্মকর্তাদের আশীর্বাদপুষ্ট কয়েকশ দালাল ছাড়াও কার্যালয়টির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যরাও এ কাজে জড়িত। গাড়ির যাবতীয় কাগজপত্র সম্পাদনের দালালি বাণিজ্য চলছে দেদার। যদিও পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা বিআরটিএ আঙিনা ‘দালালমুক্ত পরিবেশ’ বলছে; কিন্তু এর আড়ালেই চলছে শুভংকরের ফাঁকি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দালালরা কাগজপত্রের স্ট্যাপলার পিনে আটকানো খামের ভেতরেই পাঠিয়ে দিচ্ছে কর্মকর্তাদের চাহিদামাফিক সেলামির টাকা। যথারীতি ফাইলিং করে কাজ সম্পাদন শেষে আনসারদের হাত ঘুরে একই কায়দায় গাড়ির ফিটনেস, লাইসেন্স কিংবা নবায়ন পেপারস পৌঁছে যাচ্ছে দালালদের কাছে।

দেখা যায়, প্রধান গেটের বাম পাশেই দেওয়া হচ্ছে তথ্যসেবা ও লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স। এখানে ২০০ টাকা না দিলে নানারকম হয়রানি পোহাতে হয়। তার পাশেই দেওয়া হচ্ছে ডিজিটাল নম্বর প্লেট। সেখানেও দিতে হয় ৫০০ টাকা। এ টাকা না দিলে নম্বর প্লেট যে কতদিনে মিলবে, তার কোনো হিসাব নেই। নম্বর প্লেট লাগাতে ব্যস্ত ব্যক্তির পাশেই একটি ব্যাগে নম্বর-প্লেট লাগানোর ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দুই কিশোর। তাদের হাতে ২০০ টাকা না দিলে কোনোভাবেই লাগানো সম্ভব হয় না নম্বর প্লেট।

এক নম্বর ভবনের নিচে যেতেই দেখা যায়, লোকজনের ভিড়ে পা ফেলার তিল পরিমাণ জায়গাও যেন নেই। সেখানে দুই-আড়াই ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেও ছবি তোলার সিরিয়াল মেলে না। তবে পাশেই দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের হাতে ২০০ টাকা গুঁজে দিলে ৫-১০ মিনিটের মধ্যেই ছবি তোলা সম্পন্ন হয়ে যায়। টাকা দিলে হয়রানি-ভোগান্তি ছাড়াই চাহিদামাফিক কাজ সম্পাদন হয়ে যায়। এ হচ্ছে মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের আসল চিত্র।

সেবা নিতে আসা রাজধানীর কল্যাণপুরের বাসিন্দা আসিফ বলেন, সাধারণ প্রক্রিয়ায় সেবা পেতে অযথা হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ দালালদের দিয়ে দ্রুত কাজ হয়ে যাচ্ছে।

লাইসেন্স নিতে আসা আকবর আলী বলেন, একটি লাইসেন্স নিতে কমপক্ষে অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে পুনঃপরীক্ষার জন্য দিতে হয় কমবেশি তিন হাজার টাকা। পেশাদার লাইসেন্সের পুলিশ তদন্ত শেষে প্রতিবেদন পেতেও ঘুষ লাগে। এখানে ঘুষ না দিলে তদন্ত প্রতিবেদন মাসের পর মাস খুঁজে পাওয়া যায় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির উপপরিচালক (প্রকৌশল) মো. মাসুদ আলম বলেন, বিআরটিএ কার্যালয়ে সেবা পেতে কোনো হয়রানির শিকার হতে হয় না। তিনি বলেন, এখানে দালাল ছাড়া নির্বিঘ্নে সেবা নিতে পারেন যে কেউ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads