• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

রেলের ১০ ইঞ্জিন ক্রয়ে অনিয়ম

৩২শ কেভিএ’র দামে ক্রয় ২২শ কেভিএ জেনারেটর

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৮ ডিসেম্বর ২০২০

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আগামী ১০ জানুয়ারি রেলবহরে যুক্ত হচ্ছে আরো ১০টি ইঞ্জিন। তবে রেলের ক্রয় কমিটি ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে এসব ইঞ্জিনে দুর্বলতা ও ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি কোরিয়া থেকে ইঞ্জিনগুলো দেশে পৌঁছেছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী সঠিক ইঞ্জিন দেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। দুই হাজার ২০০ অশ্বক্ষমতাসম্পন্ন এই ইঞ্জিন ১০টি চালাতে প্রতিটির জন্য ৩ হাজার ২০০ কেভিএ (কিলো ভোল্ট এম্পিয়ার) ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর ক্রয়ের চুক্তি হয়। কিন্তু ৩ হাজার ২০০ কেভিএ-এর দামেই কেনা হয়েছে ২ হাজার ২০০ কেভিএ জেনারেটর, যা দিয়ে ট্রেনের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন ইঞ্জিনগুলোর অশ্বক্ষমতা ২২শ কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।  

রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নানা সমস্যায় জর্জরিত এই ১০ ইঞ্জিন বাংলাদেশকে সরবরাহ করেছে কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন কোম্পানি (সিসিআইসি)। ইঞ্জিনগুলো তৈরিতে অনুসরণ করা হয়নি সঠিক কারিগরি নির্দেশনা। এসব ইঞ্জিন সরাসরি পরীক্ষা করে দেখা যায়, এতে চুক্তি অনুযায়ী অনেক কিছু  দেয়নি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। অথচ একই স্পেসিফিকেশনে এ কোম্পানি থেকে দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে আরো ৬০টি ইঞ্জিন কেনার চুক্তি হয়েছে। সেই ইঞ্জিনগুলোও একইভাবে সরবরাহ করার চেষ্টা হতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন রেল কর্মকর্তারা। 

এদিকে এ ঘটনা তদন্তে রেল কর্তৃপক্ষ ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। কমিটির আহ্বায়ক রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মো. ফারুকী। সদস্য রয়েছেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মঞ্জুর উল-আলম চৌধুরী এবং বুয়েটের একজন। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা আছে। কিন্তু তদন্ত দল এখনো অভিযোগকারী প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য গ্রহণ করেনি।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ১৭ মে ১০টি মিটার গেজ লোকোমোটিভ ইঞ্জিন সরবরাহে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ২৯৭ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার ৫৬০ টাকা ব্যয়ে ক্রয় করা ইঞ্জিনগুলো চুক্তির ২৪ মাসের মধ্যে সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী চলমান কোভিড-১৯-এর কারণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছুটা বেশি সময় লাগে বাংলাদেশে পৌঁছতে। এ চুক্তির আওতায় ১ ও ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজ থেকে ইঞ্জিনগুলো খালাস হয়। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব ইঞ্জিন বুঝে নেন।

কোরিয়ার কোম্পানিটির বাংলাদেশি স্থানীয় এজেন্ট মেসার্স গোলাম মোস্তফা অ্যান্ড সন্স। চুক্তিপত্র অনুযায়ী এরই মধ্যে ইঞ্জিন সরবরাহকারী কোম্পানিটি ২৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম বাবদ নিয়েছে। এখন আরো ৬৫ শতাংশ অর্থ ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা চালাচ্ছে। এই অর্থ পরিশোধ করা হলে ৯০ শতাংশ মূল্যই পরিশোধ হয়ে যাবে। এতে ইঞ্জিনের বিচ্যুতিগুলো সংশোধনের উপায় থাকবে না।

জানা গেছে, আমদানি করা এসব ইঞ্জিনের প্রতিটির ওজন ৯০ টন। রেলের এর আগে তুলনামূলক ভালোমানের ইঞ্জিনগুলোর গড় ওজন প্রায় ৭০ টন। রেলে বহরে থাকা মেইল লাইনে চলমান ২৬০০, ২৭০০ ও ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলো ১৫০০ হর্স পাওয়ারের। এসব ইঞ্জিন গড়ে ৮০ কিলোমিটার গতিবেগে চলাচল করতে পারে।

অন্যদিকে নতুন আমদানি করা ইঞ্জিনগুলো ২২০০ হর্স পাওয়ারের। নতুন এ ইঞ্জিনগুলোর সিরিজ নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০১ থেকে ৩০১০ পর্যন্ত। 

এ সিরিজের নতুন এ ১০টি ইঞ্জিন ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিবেগে চলাচল করতে পারবে। প্রতিটি ইঞ্জিন গড়ে ৩০-৩৫টি কোচ যাত্রীসহ সর্বোচ্চ গতিতে চলাচল করতে সক্ষম। নতুন ইঞ্জিনগুলো যুক্ত হলে ট্রেনের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহনের সময়সীমা আগের তুলনায় আরো কমবে বলে জানান রেলওয়ে কর্মকর্তারা। যদিও অধিক গতিসম্পন্ন ইঞ্জিনগুলো চালানোর জন্য দেশের বর্তমান রেললাইন উপযোগী নয়। কারণ, দেশে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৭২ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো যায়। ভবিষ্যতে রেলের উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই ইঞ্জিনগুলো কেনা হয়েছে।

রেলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (প্রকল্প) ও প্রকল্প পরিচালক শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন,  ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের আগে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন করার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে সিঙ্গাপুরের মেসার্স সিসিআইসি লিমিটেড নিয়োজিত ছিল। ইঞ্জিনগুলো জাহাজে তোলার আগে কারিগরি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে কি না সেই সার্টিফিকেটও দেওয়ার কথা। গত ২৫ জুলাই ইঞ্জিনগুলো বাংলাদেশের উদ্দেশে কোরিয়ায় জাহাজীকরণ করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি লোকোমোটিভগুলোর কোনো প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন রিপোর্ট দাখিল করেনি রেলওয়েকে।

তিনি জানান, পরে প্রতিষ্ঠানটি ১২ আগস্ট সই করা দুই থেকে তিন ঘণ্টার ব্যবধানে রেলওয়েকে দুটি মেইলের মাধ্যমে প্রি-শিপমেন্ট সার্টিফিকেটে পাঠায়। কিন্তু তাদের রিপোর্টে মূল কিছু যন্ত্রাংশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল না। একই তারিখে দুই ধরনের সার্টিফিকেট ইস্যুর কারণে ওই সার্টিফিকেটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও আমাদের সন্দেহ হয়। পরে প্রকল্প দপ্তর থেকে বারবার তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু তা পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে গত ৩১ আগস্ট বন্দরে ইঞ্জিন ১০টি চলে আসে। সরবরাহকারী বা পিএসআই কোম্পানির এমন অনিয়মের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে ধরা পড়লেও রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে ডেকে ইঞ্জিন খালাসের জন্য মৌখিক নির্দেশ দেয়। ২ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস করা হয়। এতে সন্দেহ আরো বাড়ে।

লোকোমোটিভ এ ইঞ্জিনগুলো চট্টগ্রামের পাহাড়তলি লেকো শেডে রয়েছে। প্রতিটি ইঞ্জিনে জেনারেটর, মডেল, কত কেভিএ বা ক্ষমতাসম্পন্ন সেই রিপোর্ট এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি রেলওয়ে। এ জন্য গঠিত কমিটি কাজ করছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads