• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

গণপরিবহনে স্বেচ্ছাচারিতা

ওয়েবিলে জিম্মি যাত্রীরা

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

রাজধানীতে সাধারণ মানুষের গণপরিবহন ব্যবস্থা চরম দুর্দশাগ্রস্ত ও অসহনীয়। কাগজে-কলমে গণপরিবহনে কোনো সিটিং সার্ভিস নেই। ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ করতে চার বছর আগে সরকার বাস ও মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও বাসমালিকরা ওই সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আদায় করছেন অতিরিক্ত ভাড়া।

পরিবহন সংকটের কারণে ঢাকার যাত্রীদের বাদুড়ঝোলা হয়ে যাতায়াত করতে হয়। এর মধ্যে ওয়েবিলের নামে এক টাকা ৬০ পয়সার ভাড়ায় আদায় করা হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। এসি বাসে ভাড়া আদায়ের অবস্থা আরো ভয়াবহ। আর যত্রতত্র বাস না থামানোর জন্য বেশ কয়েকবার পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ থেকে বলা হলেও কোনো বাসই মানছে না সে নির্দেশনা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র জানায়, রাজধানীতে বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া কিলোমিটার প্রতি বাস ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং মিনিবাস এক টাকা ৬০ পয়সা। একই সাথে বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা, মিনিবাসের ৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, বাসে আসন থাকবে ৫২টি, মিনিবাসে ৩০টি। দুটি আসনে হেলান দেওয়া স্থানের দূরত্ব হবে ২৬ ইঞ্চি। কিন্তু ঢাকার পরিবহন মালিকরা এ আইনটিও অমান্য করে ইচ্ছেমতো আসন বসিয়েছেন। অতিরিক্ত আসন বসানোর ফলে যাত্রীরা পা সোজা করে বসতে পারেন না। অন্যদিকে আসনে বসা এবং দাঁড়িয়ে (বাদুড়ঝোলা) চলাচল করা যাত্রীদের একই ভাড়া দিতে হয়। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বিআরটিএ ও সড়ক পরিবহন মালিকদের এক সমন্বিত মিটিং রাজধানীর বাসগুলোতে ‘সিটিং সার্ভিস’ বা ‘গেটলক’ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাসের গায়ে ‘সিটিং সার্ভিস’ বা ‘গেটলক’ লেখা বন্ধ হলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নামে চালু হয় ওয়েবিল পদ্ধতি। বিআরটিএসহ হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া কোনো বাসই এখন আর যাত্রীর কাছ থেকে লোকাল ভাড়া নেয় না।  

মিরপুর থেকে মতিঝিল রুটে চলাচলকারী বাসের যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ রুটে চলাচলকারী সব বাসই চলছে ওয়েবিল পদ্ধতিতে। বাসগুলোতে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, যাত্রী নেওয়া হচ্ছে দাঁড় করিয়ে অথচ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে সিটিং সার্ভিসের। ওয়েবিল সেবার নিয়ম হচ্ছে-মিরপুর-১০ থেকে কারওয়ানবাজার পর্যন্ত ভাড়া ১৫ টাকা। কারওয়ানবাজার সিগন্যাল পার হলেই ভাড়া বাড়ছে আরো দশ টাকা। ফলে বাংলামোটর বা শাহবাগ নামলেও যাত্রীকে ভাড়া গুনতে হবে ২৫ টাকা। তা ছাড়া বাংলামোটর সিগন্যালে এই পরিবহনের কোনো স্টপেজ নেই। তাই যেখানে ওয়েবিল সই হয় সেখানেই যাত্রীরা নামতে বাধ্য হন। অথচ বিআরটিএ নির্ধারিত হিসাবে মিরপুর-১০ থেকে বাংলামোটর (প্রায় ৭ কিমি) ১১ টাকা। এ ক্ষেত্রে যাত্রী প্রতি অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে ১৪ টাকা। ওয়েবিল সেবার এই নিয়মের কারণে এরকম ঘটনা ঘটছে আরো অনেক বাসে।

বিহঙ্গ পরিবহনের নিয়মিত যাত্রী তোফায়েল হোসেন বলেন, একটি ওয়েবিল থেকে আরেকটি ওয়েবিল পর্যন্ত ১০ টাকা ভাড়া নেবে। কারওয়ানবাজার থেকে বাংলামোটর কত দূর? এইটুকু জায়গার জন্য আমি দশ টাকা কেন দেব? এরা মানুষকে জিম্মি করছে। আমার মনে হয় না গাড়ির মালিকদের এমন নিয়ম আছে। এটা ড্রাইভার-হেলপাররা মিলে বাড়তি আয়ের ধান্দা করছে। অথচ সরকার ভাড়ার জন্য আলাদা চার্ট করে দিছে, সেগুলো বাদ দিয়ে তারা একরকম ডাকাতিই করছে।

একইভাবে যাত্রী তোলা ও ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে এয়ারপোর্ট রোড হয়ে সদরঘাট এবং যাত্রাবাড়ী রুটে। উত্তরা টু পোস্তগোলা রুটে চলাচল করা ‘রাইদা’ কোম্পানির শুরু থেকেই ভালো সার্ভিসের একটু নাম রয়েছে। সরেজমিন এ বাসেও দেখা গেল নানা অনিয়ম। বাদুড়ঝোলা করে যাত্রী তোলাসহ যত্রতত্র স্টপেজ ছাড়াই থামছে বাসগুলো। যাত্রীরা সবাই উচ্চবাচ্য করলে কিছুক্ষণ যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা কিছুদিন বন্ধ করে, আবার আগের মতো যেখানেই হাত দেখায় সেখানেই যাত্রী নেওয়া শুরু করে।

এ বাসে নিয়মিত চলাচল করা যাত্রী আবুল কালাম বলেন, দিয়াবাড়ী থেকে পোস্তগোলা ৫০ টাকা ভাড়া। কিন্তু আমি সায়েদাবাদ নামলেও আমাকে ৫০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। এটাই তাদের নিয়ম। আমার পাশের সিটের যাত্রী উঠেছেন এয়ারপোর্ট থেকে। তিনি যাবেন সায়েদাবাদ। তার ভাড়াও ৫০ টাকা। শুভঙ্করের ফাঁকিটা হলো, দিয়াবাড়ী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এই সিটের আগের যাত্রী ১০ টাকা দিয়ে নেমে গেছেন। এয়ারপোর্ট থেকে তিনি যেমন ৫০ টাকা দিচ্ছেন, আমি দিয়াবাড়ী থেকে উঠেও ৫০ টাকা দিচ্ছি। আবার আমরা দুজনই সায়েদাবাদ নেমে যাচ্ছি। তখন এই সিটগুলো ফাঁকা। স্বভাবতই এই দুই সিটে আবার নতুন যাত্রী উঠবেন, তারা ১৫ টাকা দিয়ে সায়েদাবাদ থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত যাবেন। তাহলে একটি সিটের মোট ভাড়া ৫০ টাকার বেশি হয়ে যাচ্ছে। আরো ভেঙে গেলে মোট ভাড়া আরো বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে ৫০ টাকার একটি সিটের ভাড়া ৭৫ থেকে ৯০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। এরকম প্রতিদিনই যাত্রীদের কাছ থেকে ডাবলের ডাবল ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, যা কেউই তদারকি করছেন না।

সার্বিকভাবে রাজধানীর সব গণপরিবহনে একই নিয়ম চলছে। ওয়েবিলে বাসগুলো চলাচল করলেও সকলের উদ্দেশ্য এক, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা। যাত্রীদের একরকম জিম্মি করেই কোনো কোনো রুটে নেওয়া হচ্ছে চারগুণ ভাড়া। যদিও দায় নিতে নারাজ বাসমালিক সমিতি। আর সমস্যা নিরসনে ফ্র্যাঞ্জাইজিভিত্তিক বাস পরিচালনার যে সমাধান বাতলে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা, সেটিও সহসা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দেখছে না খোদ বিআরটিএ।

ওয়েবিল পদ্ধতির বাসগুলো কাগজে-কলমে যাত্রী সংখ্যা ও সিট অনুসারে (সিটিং সার্ভিস) চলে। চেকারের মাধ্যমে বাসগুলো নির্দিষ্ট কিছু স্টপেজে যাত্রীসংখ্যা গণনা হয়। আর ওয়েবিল নামে একটি কাগজে কোম্পানির নির্দিষ্ট চেকার আসন হিসাবে যাত্রীসংখ্যা লিখে দেন। সিটের অতিরিক্ত দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীর হিসাব ওয়েবিলে লেখা হয় না। এ ক্ষেত্রে বাস কন্ডাক্টরের কাছ থেকে অতিরিক্ত ১০-২০ টাকা অতিরিক্ত নেন চেকার।

ওয়েবিল বৈধ বা সরকার অনুমোদিত কি না বিহঙ্গ বাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিরউদ্দিন খোকনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এটি বৈধ বা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয়, বরং বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) আমাদের যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই ভাড়াকে আমরা সুবিধামতো স্টপেজে ভাগ করে দিয়েছি। বিভিন্ন স্টপেজ কোম্পানির বেতনভুক লোক থাকে, তারা যাত্রী ও সিট হিসাব করে কাগজে লিখে দিলে সেখান থেকে আমরা যাত্রীর হিসাব পাই। সেই হিসাবে আমরা বাসের ড্রাইভার ও হেলপারের কাছ থেকে টাকা বুঝে নিই। তবে এ নিয়ে ঝগড়া বা যে ভোগান্তি হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আমাদের কোনোভাবেই কাম্য নয়, আমরা এটা চাইও না বরং এ নিয়ে নতুন করে ভাবছি। এজন্য হয়তো আমরা কাউন্টার টিকিটিং সিস্টেমে যাবার কথা ভাবছি।

ওয়েবিল বৈধ বা সরকারি অনুমোদন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, প্রতিদিন বাসের নানা ধরনের খরচ থাকে। সেইসব খরচের টাকা বাদ দিয়ে ওয়েবিলের মাধ্যমে যাত্রী হিসাব করে ড্রাইভার বা হেলপারের কাছে টাকা বুঝে নিই। তবে ওয়েবিল সরকার কর্তৃক বৈধ বা সরকার অনুমোদিত না। এটা কোম্পানির মালিকরা তাদের লেনদেনের সুবিধার কারণে তৈরি করেছে।

সিটিং-গেটলকে যাত্রীদের জিম্মি করে নেওয়া হচ্ছে চারগুণ ভাড়া প্রসঙ্গে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এটা পুরোপুরি অনৈতিক। এই অন্যায় সিটিং-গেটলক নামে কোনো সার্ভিস আইনে নেই। ৩১ আসনের বাসে ৪০-এর অধিক সিট বসানো হয়। এসব বাসে দাঁড় করিয়ে যাত্রী নেওয়া হয়, ভাড়া নেওয়া হয় ৩-৪ গুণ বেশি। এ বিষয়টি যাদের দেখার কথা তারা না দেখার ভান করছেন।

যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, বাস রুট ফ্রাঞ্জাইজি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারলে শুধু ভাড়ার নৈরাজ্য কমবে না, সবদিকে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ২০২০ সাল নাগাদ ২২টা রুটে ফ্রাঞ্জাইজিভিত্তিক বাসগুলো পরিচালনা করার কথা ছিল। সে লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে সব প্রক্রিয়া থমকে গেছে। কবে নাগাদ ফ্রাঞ্জাইজিভিত্তিক বাস চালু করা যাবে তা এখনো সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে চলতি বছরের মধ্যেই এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে পারে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads