• বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪২৯
১৪ মিনিটের অডিও ক্লিপে প্রশ্নবিদ্ধ কথিত বন্দুকযুদ্ধ

টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা একরামুল হক

সংরক্ষিত ছবি

অপরাধ

১৪ মিনিটের অডিও ক্লিপে প্রশ্নবিদ্ধ কথিত বন্দুকযুদ্ধ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক ও টেকনাফ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৩ জুন ২০১৮

মাত্র চারটি ফোনকলের মোট ১৪ মিনিট ২২ সেকেন্ডের ‘অডিও ক্লিপ’ নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চলছে। যার শেষাংশে রয়েছে টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা একরামুল হক (৪৬) হত্যার মুহূর্তের শব্দরাজি। ঘটনাস্থলে খুনিদের অসতর্কতায় দূরালাপনে সংযুক্ত থাকা নিহতের স্ত্রীর মুঠোফোনে যা ধারণ হয়ে গেছে। যাতে স্পষ্টতই শোনা গেছে অভিজাত বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সাজানোর পুরো প্রক্রিয়া। যা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সরকার ঘোষিত মাদকবিরোধী যুদ্ধকে।

বাংলাদেশের খবরের হাতে থাকা পরিসংখ্যান অনুযায়ী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গত ১৪ মে দিবাগত রাত, অর্থাৎ ১৫ মে থেকে ১ জুন দেশের ৪৫ জেলায় কমপক্ষে ১৪১ ব্যক্তি ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যার শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ১৩৯ জন কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। এ ছাড়া ধাওয়ার মুখে ঝিলের কাদাপানিতে ডুবে এবং গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে বাকি দুজন। নিহতদের মধ্যে ১৩২ জনকে মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাকি আটজনের মধ্যে রয়েছে চারজন ডাকাত, দুজন হত্যা মামলার আসামি আর একজন করে ধর্ষক, চরমপন্থি ও ছিনতাইকারী।

টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের নোয়াখালী পাড়া এলাকায় ২৬ মে রাতে নিহত একরামুলের স্ত্রী আয়েশা বেগম ৩১ মে কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই ক্লিপটি প্রকাশ করেন। এরপর একটি ইংরেজি দৈনিকের অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত হলে দ্রুতই এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত দুই দিনে এটি বাংলা ভাষাভাষী কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রথম দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধের কোনো অডিও ফাঁস হলো।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, প্রকাশিত অডিও টেপটি তাদের নজরে এসেছে। বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছেন। আর মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, অডিও ক্লিপটা শুনে এটা স্পষ্ট যে সেখানে বন্দুকযুদ্ধের ধারেকাছেরও কোনো ঘটনা ঘটেনি। যুদ্ধের লেশমাত্রও নেই। যা হয়েছে সেটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এ ব্যবস্থা একটি সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে কখনো কাম্য হতে পারে না।

অন্যদিকে বিব্রত সরকারও নানাভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। একরামুল হক নিহত হওয়ার ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে গতকাল শনিবার জানান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, য‌দি তিনি (একরামুল হক) নিরপরাধ হন, তাহ‌লে দো‌ষীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাদের আরো বলেন, ‌‌এ ‌‌ধরনের অভিযানে দু-একটি ভুল হতেই পারে।

ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপে হত্যার আগমুহূর্তে স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে একরামুলের তিন দফা আলাপের একটি অংশও রয়েছে। যেখানে তার সন্তানের শেষ জিজ্ঞাসা ছিল, ‘আব্বু তুমি কান্না করতেছ যে।’ তার পরিবারের অভিযোগ, একরামুলের বাবার নাম আবদুস সত্তার। তিনি টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালীপাড়া এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু র্যাবের পাঠানো বিবৃতিতে যার কথা বলা হয়েছে তার বাবার নাম মোজাহের মিয়া, ঠিকানা সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া।

একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম বলেন, নাম ও ঠিকানা ভুল করে উদ্দেশ্যমূলক ও রহস্যজনকভাবে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, একরামুল হক ইয়াবা ব্যবসায়ী ছিলেন না। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আয়েশা গণমাধ্যমকে আরো বলেন, হাসপাতালে গিয়ে র‍্যাব-৭-এর গাড়ি দেখে তাদের বললাম, আপনারা কেন আমার স্বামীকে খুন করছেন? তখন ওনারা বলেছেন, ওপর থেকে অর্ডার এসেছে। আল্লাহর কাছে বিচার দেন। আমরা কাজ করার মানুষ। আমরা শুধু অর্ডার পালন করছি।

আমাদের টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, একরামুলকে র্যাব মাদক ব্যবসায়ী দাবি করলেও জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ এবং স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন ইয়াবা বা কোনো ধরনের মাদক ব্যবসার সঙ্গে কখনই তার (একরামুল) সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তারা বলছে, সাদামাটা এই মানুষটি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। টেকনাফ উপজেলার বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদেরও দাবি ভালো মানুষ ছিলেন একরামুল। এমনকি পুলিশও বলছে, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাই ছিল না।

পারিবারিক সূত্রে বাল্যকাল থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন একরামুল। দীর্ঘকাল ছাত্ররাজনীতি শেষে আওয়ামী যুবলীগের রাজনীতি শুরু করেন তিনি। প্রায় এক যুগ তিনি টেকনাফ যুবলীগের প্রধান ছিলেন। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণে তিনি বার বার তিন নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তার দুই কন্যার মধ্যে বিজিবি স্কুলে নাহিয়ান হক ৬ষ্ঠ ও তাহিয়াত হক ৮ম শ্রেণিতে পড়ছে। কাউন্সিলর ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা হলেও অর্থাভাব ছিল একরামুলের। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া টেকনাফের কাইয়ুকখালী পাড়ায় ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ছয় বছর ধরেও একটি বাড়ি নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি অর্থের অভাবে।

তবে একরামুলকে মাদক ব্যবসায়ী দাবি করে কক্সবাজারের র্যাব-৭-এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন জানান, একরামুল মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন। এই তালিকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা। অপরাধজগতে তিনি ইয়াবা গডফাদার হিসেবেও পরিচিত। তিনি আরো দাবি করেন, আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী দুটি মামলায় একরামুল অভিযুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে টেকনাফ থানায় একটি মাদক সংক্রান্ত মামলা রয়েছে। ২০০৮ সালের দায়ের করা প্রথম মামলাটি আদালত খারিজ করে দেন। আর মাদক সংক্রান্ত মামলায় পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য নয়। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে র্যাবের ওই কোম্পানি কমান্ডার বলেন, আমরা তার (একরামুল) ব্যাপারে যথাযথ তথ্য সংগ্রহ করেছি। তিনি টেকনাফের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। র্যাব শতভাগ স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করছে। এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না।

টেকনাফ থানার ওসি রঞ্জিত কুমার বড়ুয়া জানান, এই থানায় একরামুলের বিরুদ্ধে কোনো ইয়াবা মামলা নেই। একটি মামলা রয়েছে তাও মারামারি মামলা।

একরামুলের ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে কিছু লোক শনিবার তারাবি নামাজের পর তার ভাইকে ডেকে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায়, জমি কেনাবেচার ব্যাপারে তারা হোটেল নেটংয়ে একরামুলের সঙ্গে কথা বলতে চায়। কিন্তু একরামুলের ফিরতে দেরি হলে পরিবারের সবাই তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। প্রথমে হোটেল নেটংয়ে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, তিনি বের হয়ে গেছেন, তবে পেছনে একটি কালো রঙের গাড়ি রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ক্রসফায়ার হলে একটি গুলি করলে শেষ হয়ে যায়। তবে তার শরীরে বেশ গুলির আঘাত রয়েছে। পাশাপাশি নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, একরামুল দলের জন্য নিবেদিত ছিলেন। কেউ ষড়যন্ত্র করে তাকে ইয়াবা ব্যবসায়ীর তকমা দিয়ে থাকতে পারে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads