• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
যেভাবে বোতল-বন্দি হলো 'জ্বীনের বাদশাহ্‌'

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

যেভাবে বোতল-বন্দি হলো 'জ্বীনের বাদশাহ্‌'

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯

'জ্বীনের বাদশাহ্' পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করার দায়ে সিআইডি পুলিশ সম্প্রতি সাত ব্যক্তিকে আটক করেছে।

সরলমনা মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে কীভাবে প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা, তার এক অদ্ভুত গল্প উঠে এসেছে পুলিশ কর্মকর্তাদের বর্ণনায়।

জাহানারা বেগম (পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হচ্ছে) একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ঢাকার হাতিরঝিল থানা এলাকায় থাকেন। সংসারে রয়েছে ছেলে এবং ছেলের বৌ।

চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে একটি বিজ্ঞাপন দেখে তিনি অবাক হন। সেই বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়, আপনার যে কোনো সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে 'জ্বীনের বাদশাহ্'।

বিজ্ঞাপনে একটি মোবাইল ফোনের নাম্বার দেওয়া ছিল। সেই নাম্বারে যোগাযোগ করার পর জাহানারা বেগমকে জানানো হয় যে ২০০১ টাকা জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।

তিনি সেটা করার পর একজন তাকে ফোন করে বলে যে 'দরবেশ হুজুর' তার সাথে কথা বলবেন এবং 'জ্বীনের বাদশাহ্'কে ব্যবহার করে তার মনোবাসনা পূরণ করবেন। এভাবেই শুরু। এর পরের কয়েক মাস ধরে 'জ্বীনের বাদশাহ্' জাহানারা বেগমের সাথে নিয়মিতভাবে কথাবার্তা চালাতে থাকে। নানা ধরনের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে জাহানারা বেগমের মধ্যে একধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়।

এক পর্যায়ে জাহানারা বেগমকে বলা হয় 'জ্বীনের বাদশাহ্' তার প্রতি সদয় হয়েছে এবং তার সঞ্চয়ের টাকা দ্বিগুণ করে দিতে রাজি হয়েছে।

এরপর চলতি বছরের পয়লা জুন থেকে পয়লা অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে জাহানারা বেগম মোট ২৫ লাখ টাকা তুলে দেন ওই 'জ্বীনের বাদশাহ্'র হাতে।

এই কাজে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বিকাশের মোট সাতটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়।

এই টাকা ছিল জাহানারা বেগমের সারা জীবনের সঞ্চয়। তার কাছে রাখা কিছু সঞ্চয়পত্রও তিনি ভাঙিয়ে নেন। শুধু তাই না, 'জ্বীনের বাদশাহ্'কে দেয়ার জন্য তিনি তার এক প্রতিবেশীর কাছে ঋণের জন্য হাত পাতেন।

ওই প্রতিবেশী যখন জাহানারা বেগমের ছেলেকে ঘটনাটা জানিয়ে দেন তখন পুরো ব্যাপারটা বেরিয়ে আসে। ছেলে এ নিয়ে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করে অভিযোগ করেন যে, প্রতারকদের একটি চক্র তার মাকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

"আমরা প্রথমে এই জালিয়াতির ব্যাপারটা জানতে পারি হাতিরঝিলের মামলা থেকে," বলছিলেন সিআইডি পুলিশের বিশেষ সুপারিন্টেনডেন্ট মোস্তফা কামাল, "মামলার ধরণ দেখে বোঝা যায় যে একটি সংঘবদ্ধ চক্র ওই মহিলার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার সাথে প্রতারণা করেছে।"

এরপর সিআইডি বিভাগের সাইবার অপরাধ দমন কেন্দ্র মামলাটির তদন্তভার হাতে তুলে নেয়।

দু'মাস তদন্ত শেষে সাইবার ক্রাইম সেন্টারের কর্মকর্তারা গত বুধবার দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা ভোলা থেকে ওই প্রতারক চক্রের সাত সন্দেহভাজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারায় প্রতারণা ও ছদ্মবেশ ধারনের মামলায় এখন অধিকতর তদন্ত চলছে।

অপরাধের মাধ্যম যখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম

এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন এবং ফেসবুক, হোয়টাসঅ্যাপ, ইমো ইত্যাদি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে প্রতিদিনই ঘটছে এই ধরনের প্রতারণা।

কামাল বলছিলেন, "এ ধরনের ঘটনা নতুন না। তবে আপনি দেখবেন এই ধরনের প্রতারণার মোডাস অপারেন্ডাই (কাজ করার পদ্ধতি) প্রায় একই রকম।"

তিনি জানান, এই কেসেও প্রতারক চক্র 'জ্বীনের বাদশাহ্' সেজে শিকারের সব সমস্যা সমাধান করে দেয়ার আশ্বাস দিত। শিকারকে নানা প্রলোভনে ভুলিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির এনআইডি ব্যবহার করে বিকাশে ভুয়া একাউন্ট খুলত এবং ওই একাউন্টগুলোর টাকা এজেন্টের মাধ্যমে তুলে ফেলতো।

সাইবার ক্রাইম সেন্টার বলছে, অনলাইন ও মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও রকেট-এর নম্বরের হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করে তারা সন্দেহ করছে, প্রতারক চক্রটি সম্ভবত আরও বহু লোকের কাছ থেকে এভাবে অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

'জ্বীনের বাদশাহ্' দেখতে কেমন?

সিআইডির বিশেষ সুপারিন্টেনডেন্ট মোস্তফা কামাল বলছিলেন, এদের মধ্যে সত্যি কোন বিশেষত্ব নেই। "এদের দেখলে মনেই হবে না যে এরা এই কাজ করতে পারে। আপনার-আমার মতোই এরা সাধারণ মানুষ।"

তিনি বলেন, তবে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো এদের বয়স।

ভোলা থেকে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশ ক'জনের বয়স ২০ থেকে ২৫ এর মধ্যে।

যাদের আটক করা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা প্রতারণার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে তিনি জানান।

'জ্বীনের বাদশাহ্' কেন টানে মানুষকে?

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মোটিভেশন হচ্ছে লোভ। পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রামে-গঞ্জে এখনও বহু প্রতারক এক ভরি সোনাকে দুই ভরি করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। সহজেই সঞ্চিত টাকা দ্বিগুণ, তিনগুণ করার লোভ এড়াতে পারেন না অনেকেই।

এছাড়াও নানা ধরনের পারিবারিক সমস্যা যেমন, দাম্পত্য কলহ, অবাধ্য সন্তান, প্রেমিক-প্রেমিকার মন জয়, কিংবা মাদক সমস্যার সমাধানের আশায়ও সরলমনা মানুষ প্রতারকদের পাতা রেশমি জালে ধরা পড়েন।

'জ্বীন' ঠেকানোর উপায় কী?

'জ্বীনের বাদশাহ্'র মতো প্রতারকের খপ্পরে পড়লে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা যায়? সিআইডি পুলিশের মোস্তফা কামাল এ নিয়ে বেশ ক'টি পরামর্শ দিয়েছেন:

- আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে 'জ্বীনের বাদশাহ্' যেসব সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয় সেগুলো বাস্তবে রূপ নেয়া প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে আপনার বাস্তব জ্ঞান ও বুদ্ধিকে ব্যবহার করতে হবে। যারা এগুলো বিশ্বাস করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ঠকেছেন।

-লোভ সংবরণ করতে হবে। যারা টাকা দ্বিগুণ-তিনগুণ করে দিতে পারে বলে দাবি করেন, সেটা পারলে তারা নিজেদের টাকা আগে দ্বিগুণ করতেন। তাই এসব দাবি আমলেই আনা উচিত না।

-কেউ এই ধরনের প্রতারণার খপ্পরে পড়লে তাকে সৎপরামর্শ দিতে হবে।

-এ ধরনের বিজ্ঞাপন চোখে পড়লে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হবে। ওয়েবসাইট কিংবা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পুলিশের নানা বিভাগের নাম্বার দেয়া থাকে। সেগুলো ব্যবহার করে সহজেই তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads