• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
অপরাধীদের অভয়ারণ্য বিমানবন্দর সড়ক

ছবি : সংগৃহীত

অপরাধ

অপরাধীদের অভয়ারণ্য বিমানবন্দর সড়ক

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০২০

রাজধানীর ব্যস্ততম বিমানবন্দর সড়ক গতিময় ও সৌন্দর্যধারী। এর কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে শেওড়া (জোয়ার সাহারা) রেলগেট পর্যন্ত অংশের দু’পাশে ফুটপাতসংলগ্ন স্থানে বাহারি ফুল ও শোভাবর্ধন গাছ রয়েছে। দিনের বেলা সেই শোভা উপভোগ করে এ পথ দিয়ে গন্তব্যে ছোটেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই ভিন্ন চিত্র। কিছু স্থানে নামমাত্র রঙিন আলো জ্বললেও অধিকাংশ স্থানই থাকে অন্ধকারে। এছাড়া আলোকস্বল্পতাও রয়েছে। উপরন্তু শীতের ঘন কুয়াশা এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি করে। 

গা ছমছম এ পথে সন্ধ্যার পর আতঙ্ক ছিনতাই। সেই সঙ্গে ঝোপের আড়ালে চলা মাদক সেবন ও পতিতাবৃত্তিসহ নানা অপকর্ম বাড়িয়ে দেয় পথচারীদের আতঙ্ক। দ্রুতলয়ে তাই পা ফেলেন এ পথে চলাচলকারী মানুষ।

এদিকে এমন পরিবেশের সুযোগ নেয় মাদকসেবী, ছিনতাইকারী ও ভবঘুরে অপরাধীরা। তাদের দৌরাত্ম্যে একের পর এক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সেখানে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার অন্য প্রধান সড়কে ৫২ ফিট পরপর লাইট থাকলেও এ সড়কে আছে ৮৪ ফিট পর।

গত ৫ জানুয়ারি কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং হত্যাচেষ্টা করে মজনু নামে মাদকাসক্ত এক ব‌্যক্তি। এমনটাই জানায় র্যাব। এরপরই এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সরেজমিন সন্ধ‌্যার পর বনানী রেলস্টেশন থেকে বিমানবন্দর স্টেশনের দিকে রেললাইন ধরে হেঁটে দেখা যায়, প্রধান সড়কেও নেই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। সড়কের আশপাশ অন্ধকার। রেললাইনে ও সড়কের পাশের ঝোপের মধ্যে জড়ো হয়ে বসে আছে ভবঘুরে ও যৌনকর্মীরা। কেউ কেউ নেশা করছে। আবার অনেকেই অসামাজিক কাজে লিপ্ত।

আরো দেখা যায়, কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে আর্মি গলফ ক্লাবের প্রবেশমুখ পর্যন্ত প্রায় তিন শ ফুট ফুটপাতের পাশ ঝোপঝাড়ে ভরা। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করার কারণে ফুটপাত থেকে ঝোপের ভেতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ব্যস্ত সড়কে একের পর এক গাড়ি ছুটছে।

চার শ্রমিককে সম্প্রতি দেখা গেছে একদিকে ঝোপঝাড়ের কিছু অংশ কেটে ফেলতে। তবে তারা কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পাশে দায়িত্ব পালন করছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তাদের একজন জানান, ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে তারা এ এলাকায় নজরদারি করছেন।

এই এলাকায় ১০ বছর ধরে বাস করছেন এক ভবঘুরে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, কমলাপুর, বনানী এবং বিমানবন্দর স্টেশনের অনেক ভবঘুরের আস্তানা এটি। নেশা করার পাশাপাশি এ পথে যারা সন্ধ্যার পর যাতায়াত করেন তাদের টার্গেট করে ছিনতাই করা হয়। ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মোবাইল, হাতঘড়ি, গলার চেইন, নগদ টাকাসহ মূল্যবান জিনিস কেড়ে নেওয়া হয়। এমনটাও হয়েছে অনেকে অন‌্য জায়গায় অপরাধ করে এখানে এসে আশ্রয় নেয়।

স্থানীয়রা বলছেন, মূলত সন্ধ্যার পর ভবঘুরেরা এখানে বেশি আসে। বনানী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আট কিলোমিটারের এই সড়কটিতে যানবাহন নির্বিঘ্নে যাতায়াত করলেও পথচারীরা পড়েন বিপদে।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সৌন্দর্যবর্ধনে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। অথচ এখানে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি।

আবদুল আজিজ নামে এলাকার এক শ্রমজীবী জানান, বাস স্টপেজে তিনি মালামাল ওঠানামার কাজ করেন গভীর রাত পর্যন্ত। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে রাস্তার দুই পাশেই বখাটেরা ঠাঁই নেয়। ছিনতাইকারী, হিজড়া, পতিতা ওতপেতে থাকে। আরেকজন জানান, ঝোপের মধ্যে ও টবের আড়ালে চলে ফেনসিডিল পান ও ইয়াবা সেবন। জোয়ার সাহারা এলাকার কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী এখানে মাদক সরবরাহ করে।

কুর্মিটোলা হাসপাতালের এক রোগীর স্বজন রোজিনা বেগম বলেন, ফুটপাতের পাশে এত ঝোপঝাড়। কোনো নিরাপত্তাকর্মী নেই। দিনের বেলায়ই মেয়েদের আতঙ্কের মধ্যে চলতে হয়। তিনি বলেন, এ এলাকায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি থাকলে ভালো হতো।

জোয়ার সাহারা এলাকার বাসিন্দা প্রিয়াঙ্কা বলেন, কিছুদিন আগে আমার মামি হাসপাতালে ভর্তি ছিল, তার গোল্ডের জিনিস (স্বর্ণালঙ্কার) নিয়ে গেছে এখান থেকে। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর তাই এ পথে লোক যাতায়াত করে না বললেই চলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোনায়েম আহমেদ বলেন, সন্ধ্যার পর উজ্জ্বল আলোর কোনো ব্যবস্থা নেই এখানে। কিছু রঙিন বাতি থাকলেও তার অধিকাংশই জ্বলে না। এসব রঙিন বাতিতে আবার মানুষের মুখ চেনার উপায় নেই। এখানে বারবার অপরাধের ঘটনা ঘটলেও নেই নিরাপত্তা প্রহরী।

প্রজাপতি পরিবহনের এক চালক বলেন, কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে থেকে শেওড়া (জোয়ার সাহারা) বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এই জায়গাটা একেবারেই অনিরাপদ। রাতে এখান দিয়ে হাঁটলে কোনো লোক দেখা যায় না।

ইমরান হাসান নামে এক পথচারী বলেন, এ পথ দিয়ে চলাচল করতে ভয় লাগে। ভবঘুরে, নেশাখোররা যেন পুরো রেললাইন অপরাধের আখড়া বানিয়ে ফেলেছে। ভয়ে কিছু বলতেও পারি না। শেওড়া, কালশী, জোয়ার সাহারার বাসিন্দাদেরই বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

গুলশান জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘এলাকাটি সংরক্ষিত। বিশেষ করে বিভিন্ন বাহিনীর অফিস, বাসাবাড়ি। পাশেই রয়েছে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। তারপরও পুলিশের নিয়মিত টহল থাকে। ইতোমধ্যে অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে এসব স্থানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হচ্ছে।’

র্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান সরওয়ার বিন কাশেম বলেন, বিমানবন্দর সড়কের দু’পাশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালির জন্য একপ্রকার ঝোপঝাড় সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে ইতোমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। পুরো রেললাইন এলাকায় ছিল অপরাধীদের আনাগোনা। ভবঘুরেদের কারণে এই এলাকায় প্রতিনিয়ত ছিনতাই, চুরিসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপ হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads