• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবা

ফাইল ছবি

অপরাধ

ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

২০১৮ সালের এপ্রিলে সব ধরনের মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ওই অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় চার শতাধিক মাদক কারবারি; গ্রেপ্তার হয় পাঁচ হাজার জন। হয়েছে অজস্র মামলাও। তবু ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবা পাচার।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, ২০১৮ সাল থেকে পরিচালিত মাদকবিরোধী অভিযানে অন্তত ৪০০ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন পাঁচ হাজার জন। নিহতদের মধ্যে ২১১ জন কক্সবাজারের ইয়াবা কারবারি ছিলেন, যাদের মধ্যে আবার ৬২ জন মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা। কেবল কক্সবাজার থেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন দুই হাজার ৩৮৮ জন। এসময় তাদের কাছে মিলেছে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ ইয়াবা।

এ ছাড়াও গত দুই বছরে দেশে প্রায় ৮ কোটি পিসের মতো ইয়াবা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) হিসাব অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়া মাদক মোট আমদানির মাত্র ১০ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ ভাগের ৯ ভাগ মাদকই বাজারে থেকে যায়। অতএব, ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ দেখেই বোঝা যায়, এ মাদক কী পরিমাণে ঢুকছে দেশে।

ইয়াবাসহ সর্বনাশা মাদকের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালেই ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ ঘোষণা করে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়মিত অভিযান, গ্রেপ্তার, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাদক কারবারিদের প্রাণ হারানোর ঘটনার পরও গত দুই বছরে ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এই মাদক এসেই চলেছে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গবেষণা ইউনিট বলছে, বাংলাদেশের ৮০ লাখ মাদকসেবীর মধ্যে ৭০ লাখই ইয়াবায় আসক্ত। এগুলো বর্তমানে সর্বনিম্ন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে বলা যায়, ইয়াবা ঘিরে দেশে ১৪ হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হচ্ছে।

সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সংস্থা ইয়াবার ভয়াবহতা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে ইয়াবার প্রবেশপথ হিসেবে বর্তমানে কক্সবাজারের সাতঘরিয়াপাড়া, উলুচামারী, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ, দমদমিয়া, লেদা, রঙ্গিখালী, মরিচ্যা, রেজুখাল, শাপলাপুর, নোয়াখালীয়াপাড়া, পালংখালী, আমতলী, বান্দরবানের গর্জনবুনিয়া, তুমব্রু ও মৌলভীবাজার সীমান্তের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরসংশ্লিষ্ট এলাকা দিয়ে ইয়াবা আসছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ওইসব সীমান্তে সতর্ক প্রহরা থাকলেও বন্ধ হচ্ছে না ইয়াবার চালান আসা। একবার সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকতে পারলেই ইয়াবা সড়ক, নৌ ও আকাশপথে সরবরাহ হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী মিয়ানমারের ৩৭টি কারখানায় ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারকে এসব ইয়াবার কারখানা গুঁড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তারা তা করেনি। আমাদের ধারণা ইয়াবা কারবারের সঙ্গে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য জড়িত।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ইয়াবা ব্যবসা কমেছে, তবে নৌপথ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতো। সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না।

টেকনাফ ও উখিয়া জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অ্যাডিশনাল এসপি) নিহাদ আদনান বলেন, আমরা অধিকাংশ মাদক পাচারকারীকে শনাক্ত করেছি, ধরেছি। ইয়াবার ব্যবসা অনেক কমেছে। তবে তারা পাচারের রুট পরিবর্তন হচ্ছে। কখনো সমুদ্র দিয়ে, কখনো আকাশপথে মাদক পাচার হচ্ছে। ঘন ঘন রুট পরিবর্তন উদ্বেগজনক। তবে তাদের ধরতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন) ইকবাল হোসেন বলেন, গত ২ বছরে ১২৩ জন মাদক ব্যবসায়ী এখানে আত্মসমর্পণ করেছে। অন্যদের ধরতেও নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন বলেন, ইয়াবা বিশ্বব্যাপী একটি হুমকি। কোনো দেশ চাইলেই একা ইয়াবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে না। ইয়াবার চেইনটি সাধারণত চাহিদার ওপর নির্ভর করে। চাহিদা কমাতে না পারায় ইয়াবা ব্যবসাও কমছে না।

মাদকসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের গবেষক প্রফেসর ড. এমদাদুল হক বলেন, পারিবারিক সচেতনতা ও নজরদারির মাধ্যমে আমাদের প্রথমে ইয়াবার চাহিদা কমাতে হবে, তাহলে এমনিতেই এর ব্যবসা ও অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়ে যাবে।

কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণের পর ধারণা করা হয়েছিল ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হবে। কিন্তু তা হয়নি, বরং তা বেড়ে গেছে। এখন বাকিতে ইয়াবা নিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।

র‍্যাব-৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মশিউর রহমান বলেন, এত তৎপরতার মধ্যেও বড় বড় চালান ঢুকছে। রোহিঙ্গাদের অনেকে এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এদের সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও সরকারদলীয় সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, ইয়াবা পাচার যে কোনোভাবেই থামাতে হবে। এ জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ইয়াবা থামাতে না পারলে ভয়াবহ পরিণতি হবে, যার দায় কেউই এড়াতে পারবেন না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads