• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
অর্থপাচার ঠেকাতে আটঘাট বেঁধে নামছে এনবিআর

প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে

প্রতীকী ছবি

অর্থ ও বাণিজ্য

অর্থপাচার ঠেকাতে আটঘাট বেঁধে নামছে এনবিআর

#পুনর্গঠন করা হয়েছে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল # নিরীক্ষা করা হবে সন্দেহজনক লেনদেন

  • কাওসার আলম
  • প্রকাশিত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে জানা গেছে, সঠিক তদারকির অভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে তারা। ২০১৪ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ‘ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল’ গঠন করলেও অর্থপাচার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লেনদেনের তথ্য সংগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে সেলের কার্যক্রম। কিন্তু যাচাই-বাছাই করে লেনদেনের তথ্যের সঠিকতা বা যথার্থতা নিশ্চিত করতে পারেনি। অবশেষে সেলটিকে পুনর্গঠন করে ট্রান্সফার প্রাইসিং জালিয়াতি ঠেকাতে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এনবিআরের প্রথম সচিব শাব্বির আহমেদকে প্রধান করে সম্প্রতি সেলটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। পুনর্গঠিত সেলটি শিগগিরই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সন্দেহজনক লেনদেনের নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করবে।

এনবিআরের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলকে শক্তিশালী করতে তা পুনর্গঠন করা হয়েছে। সেলটি বহুজাতিক কোম্পানির লেনদেনের তথ্য নিরীক্ষা করবে এবং শিগগিরই এ কার্যক্রম শুরু হবে। এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো যদি কোনো অনিয়ম করে থাকে, তা বেরিয়ে আসবে এবং সরকারের রাজস্ব ফাঁকিও ধরা সম্ভব হবে। এতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আসবে বলেও মনে করেন তিনি।

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে কারসাজির বিষয়টি প্রমাণ করা খুবই কঠিন। এটি আমাদের দেশে খুবই নতুন এবং এ বিষয়ে দক্ষ জনবলের সঙ্কট রয়েছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক সদস্য ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার বা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নত বিশ্বেও একটি বড় সমস্যা। এটি প্রমাণ করাও সহজ নয়। এ বিষয়ে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের পাশাপাশি আইনের কার্যকর ব্যবহারে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।

প্রসঙ্গত, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সহযোগী বা সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে। সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে কিংবা মূল কোম্পানি থেকে পণ্য বা সেবা কেনাবেচা কিংবা মূলধন সংগ্রহ করে থাকে। পণ্য বা সেবার মূল্য কিংবা মূলধনের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করাকেই ট্রান্সফার প্রাইসিং বলা হয়। কিন্তু  ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের ক্ষেত্রে পণ্য বা সেবার যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়, তা যথার্থ নয় বলেই ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। পণ্য বা সেবার মূল্য বেশি দেখিয়ে কিংবা নানা উপায়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অর্থপাচার করছে। বিদেশে অবস্থিত অন্য কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশ করেও ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচারের ঘটনা ঘটছে। সাধারণত করহার বেশি এমন দেশে থেকে করহার কম রয়েছে- এমন দেশের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে এ অর্থ পাঠানো হয়। এভাবে বিশ্বজুড়ে বহুজাতিক কোম্পানি কর এড়িয়ে যায় বা ফাঁকি দেয়।

আন্তর্জাতিক কয়েকটি গবেষণা সংস্থার মতে, অবৈধভাবে যেসব দেশ থেকে অর্থপাচার হয় বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। অর্থপাচারের মাধ্যমগুলোর মধ্যে ট্রান্সফার প্রাইসিং অন্যতম। শুধু এ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার (১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা) পাচার করে নিয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো বলছে, আয়তনের দিক থেকে ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনেক বেশি। এ কারণে এখানে পণ্যের চাহিদা বেশি হওয়ায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ব্যবসার জন্য সহজেই আকৃষ্ট হয়। তাছাড়া আইনের দুর্বলতা এবং দক্ষ জনশক্তি না থাকায় সহজেই কর ফাঁকি দেওয়া যায় বিধায় এ দেশে বিনিয়োগে বেশ আগ্রহী তারা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে শাখা কোম্পানি খুলে তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে এবং নতুন করে অনেকেই শাখা কোম্পানি খুলছে।

এমন পরিস্থিতিতে ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যাতে অর্থপাচার করতে না পারে, সেজন্য ২০১২ সালে অর্থবিলে ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন সংযোজন করা হয়। আইনে বলা হয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তাদের সব তথ্য, স্থানান্তরের সব দলিলাদি ও রেকর্ড এনবিআরকে দিতে হবে। কোনো বহুজাতিক কোম্পানি এসব দিতে ব্যর্থ হলে তাদের প্রতিটি লেনদেনের মোট মূল্যের জন্য এক শতাংশ হারে জরিমানা দিতে হবে। বহুজাতিক কোম্পানি অথবা এর সহযোগী শাখা কোম্পানিগুলোকে তিন কোটি টাকার বেশি আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে হলে অবশ্যই এনবিআরের কাছ থেকে লেনদেন-সম্পর্কিত সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। এদিকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আন্তর্জাতিক লেনদেন কার্যক্রম তদারকি করতে ২০১৪ সালে এনবিআর একটি ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠন করে। সেলটি কোম্পানিগুলো থেকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করলেও সেগুলো নিরীক্ষায় খুব সফলতা দেখাতে পারেনি। অবশেষে এ কাজে গতি আনতে গত আগস্ট মাসে সেলটি পুনর্গঠনে আট কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে এনবিআর। তারা দেশে ব্যবসারত বহুজাতিক কোম্পানির লেনদেনের ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন সেবা, বিক্রয় ও বিপণন সেবা, গবেষণা উন্নয়ন, সফটওয়্যার, আইসিটি, টেকনিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, কমিশন, লজিসটিকস, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সুদ, সম্পদ বিক্রি, লিজ পেমেন্টেস, বীমা, গ্যারান্টি, ঋণ, বিনিয়োগসহ যাবতীয় তথ্য পর্যালোচনা করবেন। বাংলাদেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে- এ ধরনের  বিদেশি কোম্পানিগুলোর ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের যাবতীয় তথ্য জানাতে এনবিআরের অধীন কর অঞ্চলগুলোকে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইতোপূর্বে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল মাঠপর্যায় থেকে প্রায় ১৫০টি বহুজাতিক কোম্পানির আন্তর্জাতিক লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। প্রাথমিকভাবে এর মধ্য থেকেই সন্দেহজনক লেনদেনকারী বা ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ থাকা কোম্পানির তথ্য যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হবে। যেসব কোম্পানির লেনদেনে ‘সন্দেহ’ তৈরি হবে, সেগুলোতে বিশেষায়িত অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি বিদেশে লেনদেন আছে- এমন আরো প্রায় ৯০০ প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে। এখন ওই সব প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের তথ্যও খতিয়ে দেখা হবে। এর মাধ্যমে ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর অর্থপাচার রোধ কমে আসবে এবং সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে বলে আশা করছেন তারা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads