• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হবে ২০২৩ সালে

সংগৃহীত ছবি

অর্থ ও বাণিজ্য

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হবে ২০২৩ সালে

শিগগিরই একনেকে উত্থাপন

  • মো. রেজাউর রহিম
  • প্রকাশিত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতেই নির্মাণ হচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর (ডিপ সি-পোর্ট)। সরকার আশা করছে, ২০২৩ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে এই গভীর সমুদ্রবন্দর। আর আগামী আগস্টের দিকে বন্দরের মূল অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হবে। এদিকে শিগগিরই মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উত্থাপন হচ্ছে। এ প্রকল্প বর্তমান সরকারের একটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত। এ ছাড়া এ গভীর সমুদ্রবন্দরটি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে একটি মাইলফলক হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়িসংলগ্ন এলাকায় সাগরের পানিপ্রবাহ, ভূ-প্রাকৃতিক অবকাঠামো সুবিধার পাশাপাশি এখানে নির্মিতব্য কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জাহাজ আগমন-নির্গমনের চ্যানেল থাকায় ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত এই গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রাথমিক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রস্তাবিত এই গভীর সমুদ্রবন্দরে প্রথম পর্যায়ে দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এ জন্য বন্দরস্থলে ৩২০ থেকে ৩৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) আট হাজার টিইইউএস কনটেইনারবাহী বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় আগামী আগস্টের মধ্যে এ বন্দরের মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হচ্ছে। আর এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি ২০২৩ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে কাজ করছে সরকার। সরকার আশা করছে, এই সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতিশীলতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে, যা দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে নির্মিত হচ্ছে বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

এ ব্যাপারে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পটি সরকারের একটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। শিগগিরই প্রকল্পটি একনেক বৈঠকে উত্থাপন  করা হবে।  তিনি বলেন, এ বন্দর নির্মাণে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) আর্থিক সহযোগিতা করবে। এ প্রকল্পের ১৪ হাজার কোটি টাকার ডিপিপি ইতোমধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ বন্দর নির্মাণ সম্পন্ন হলে দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা অনেকাংশে বৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নত দেশ বিনির্মাণের বিষয়টি আরো গতি পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সূত্র জানায়, মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বাস্তবায়নে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। জাইকা এতে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। আর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। জানা গেছে, এই প্রকল্পে জাইকা ঋণ বাবদ দেবে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকারের ফান্ড থেকে ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অর্থায়ন করবে ২ হাজার ২১৩ কোটি ৯৪ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে অন্যান্য কাজের সঙ্গে প্রায় ২৮ কিলোমিটার চার লেনবিশিষ্ট সড়ক এবং ১৭টি সেতু নির্মাণ করা হবে। আর এই ১৭টি সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় সাত কিলোমিটার। প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। এটি বাস্তবায়িত হলে ১৯ মিটার ড্রাফটের বড় জাহাজ (মাদার ভেসেল) এই বন্দরে ভিড়তে পারবে। ২০২৩ সালে একটি মাল্টিপারপাস জেটি ও একটি কনটেইনার জেটি চালুর মধ্য দিয়ে এ গভীর সমুদ্রবন্দরের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হবে। 

আরো জানা গেছে, ইতোমধ্যে জাইকা এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কারিগরি সম্ভাব্যতার সমীক্ষা প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরটি জাপানের কাশিমা বন্দর এবং নিগাতা (পূর্ব) বন্দরের মডেল অনুসরণ করে নির্মাণ করা হবে। অর্থাৎ সমুদ্রের কিনারা নয়, জাহাজ চলাচলের চ্যানেল তৈরির মাধ্যমে বন্দরকে মূল সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (দি বিগ-বি)’ শীর্ষক উদ্যোগের আওতায় মাতারবাড়িতে বাণিজ্যিক, গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হচ্ছে।

অন্যদিকে জাইকার অর্থায়নে এ প্রকল্পের অবকাঠামোগত বিনির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে যেসব সমুদ্রবন্দর রয়েছে তার কোনোটিই গভীর সমুদ্রবন্দর নয়। ফলে ডিপ ড্রাফটের কোনো জাহাজ (ভেসেল) এসব বন্দরের ভিড়তে পারে না। তাই ডিপ ড্রাফট ভেসেলের জেটি সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাতারবাড়িতে এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক কনটেইনারবাহী জাহাজ, খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারকে জেটিতে ভেড়ার সুযোগ থাকবে এই বন্দরে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমানো এবং দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানি চাহিদা পূরণ  করা এ বন্দর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য।

চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০০ টিইইউএস কনটেইনার নিয়ে ভিড়তে পারে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কলম্বো, করাচি ও চেন্নাই বন্দরে এর কয়েক গুণ বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ ভিড়তে পারে। এ জন্য মাতারবাড়িতে অধিক ড্রাফটের জাহাজের সমুদ্রবন্দর কনটেইনার পরিবহন এবং বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য এই গভীর সমুদ্রবন্দর জরুরি। প্রস্তাবিত মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরে ১৬ মিটার গভীরতার জন্য মাদার ভেসেল ভেড়ার সুযোগ থাকবে এবং একসঙ্গে ৮ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। ফলে ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এদিকে মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরের পার্শ্ববর্তী কানেকটিভিটি উন্নয়নেও ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সড়ক পথে পণ্য পরিবহনে সড়ক ও জনপথ বিভাগ চকরিয়া হয়ে মাতারবাড়ি পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ করবে এবং এ সড়ক যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে। এ ছাড়া  রেলপথ বিভাগের চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনধুম পর্যন্ত  প্রস্তাবিত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প মাতারবাড়ি বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads