• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
এমন হেমন্ত আর না আসুক

আইয়ুব বাচ্চু

ছবি : সংগৃহীত

আনন্দ বিনোদন

এমন হেমন্ত আর না আসুক

  • সোহেল অটল
  • প্রকাশিত ১৯ অক্টোবর ২০১৮

এই তো হেমন্ত নেমেছে দুদিন হলো। হিম হিম ভোরের সকাল এসেছে বাঙালির জীবনে। ভাদ্রের তাপদাহ থেকে মুক্তির দিন এসেছে নগর জীবনে। আকাঙ্ক্ষিত শীতের মোহনায় দাঁড়িয়ে এসেছে আরো একটি বিষাদমাখা ভোর। যে ভোরে নিভে গেছে আইয়ুব বাচ্চু নামের একটি গানের প্রাণ। যে ভোর অশ্রুসিক্ত করে গেছে দেশের সঙ্গীতাঙ্গন।

১৮ অক্টোবর ২০১৮। দেশের সঙ্গীতের ইতিহাসে দিনটি হিম হিম ভোরের নরম সূর্যোদয়ের সাক্ষী হয়ে থাকবে না। সঙ্গীতের কলিজা চেরা এক আত্মঘাতী ভোর হয়ে থাকবে। এদিন আইয়ুব বাচ্চু মারা গেছেন।

বাংলাদেশের রক মিউজিকের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন আইয়ুব বাচ্চু। তার নামে টপ করে স্যালুট ওঠে বাংলা গানের শ্রোতাদের বুকে। কী এক নিবিষ্ট সঙ্গীতানুরাগের দৃষ্টান্তে মোহিত করে গেছেন শ্রোতাদের। সঙ্গীত সাধকদেরও বটে। আইয়ুব বাচ্চু, শুধু সঙ্গীত সাধক ছিলেন না। ছিলেন সত্যিকার সঙ্গীত যোদ্ধা। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে তার জন্য সঙ্গীতচর্চা ছিল রীতিমতো যুদ্ধ। ঘরের সঙ্গে যুদ্ধ। পড়শীর সঙ্গে যুদ্ধ। যুদ্ধটা নিজের সঙ্গেও।

বাবা চাইতেন না ছেলে বোহেমিয়ান মিউজিশিয়ান হোক। ১৯৬২-তে জন্মানো বাচ্চু সেটাই হতে চাইলেন। গিটার কাঁধে রাত-দিন, নাওয়া-খাওয়াহীন চলতে থাকল জীবন। বাবার চোখ রাঙানি, পড়শীদের খোঁচা— এসব উপেক্ষা করে নিজেকে নিবেদন করলেন রক গানের মধ্যে। রক প্যাটার্ন, বাংলা গানের ঐতিহ্যের সঙ্গে ঠিক মানানসই না, গানের তেমনই এক ধরনকে সাধনার বিষয়বস্তু করলেন। সমাজে নিজের স্বপ্নকে মানানসই করতে তাই বেগ পেতে হলো। সত্যিই সে এক যুদ্ধ!

সেই যুদ্ধে বাচ্চু জয়ী হয়েছেন। তার জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর এক পথ। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যখন আসেন, সংগ্রামের নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়। ৬০০ টাকা সম্বল করে ঢাকায় পাড়ি জমানো আইয়ুব বাচ্চুকে প্রতিটা দিন-ক্ষণ হিসাব করে চলতে হয়েছে। আর এক পা এক পা করে এগিয়ে গেছেন স্বপ্নের সিঁড়ি ধরে।

কতটা ত্যাগ, কতটা সংগ্রাম থাকলে একজন আইয়ুব বাচ্চু হওয়া যায়? তার হিসাব মেলানো ভার। তবে এমন করে আইয়ুব বাচ্চুরা আসে বলেই প্রজন্ম তৈরি হয়। গিটারের ঝঙ্কারে বাচ্চু যখন মুগ্ধ করে চলেছেন, নীরবে তখন লাখো আইয়ুব বাচ্চু তৈরি হতে থাকে দেশে দেশে। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আজকের রক ঘরানার শিল্পীদের অনেকেরই আইডল আইয়ুব বাচ্চু। তার ওই গিটারের নিপুণ তুলি তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। তরুণরা আইয়ুব বাচ্চুর মতো শিল্পী হতে চান ভেতরে ভেতরে। তার দেখানো সিঁড়ি ধরে হাঁটতে শেখেন। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি পায় নতুন নতুন শিল্পী।

আইয়ুব বাচ্চু তার গোটা সঙ্গীতজীবনে যে সংগ্রাম-সাধনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তার পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। ভক্তরা ভালোবেসে ‘এবি’ ডাকেন তাকে। তার জন্য আলাদা ‘স্যালুট’ তোলা থাকে। এই সম্মানের পুরোটাই তো তার প্রাপ্য।

তবুও, কী কারণে যেন শেষ জীবনে তার মুখ থেকে আফসোসের কথাও শোনা গিয়েছে। হয়তো কোনো অপ্রাপ্তি ছিল। হয়তো ঠিক যতটা তার পাওনা ছিল, আমরা ততটা দিতে পারিনি। তাই বলে তিনি ঠিক এভাবে, হুট করে চলে যাবেন, তা কেউই ভাবেনি। চলে যাওয়ার মতো যথেষ্ট বয়সও তার হয়নি। ৫৬ বছর চলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া তার মতো শিক্ষকের কাছে আরো অনেক শেখার ছিল এই দেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির।

গিটার খুব আপন ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। মনের আনন্দে গিটার বাজাতেন। অসাধারণ দখল ছিল মিউজিকের এই যন্ত্রের ওপর। বলতে গেলে, গিটার নিয়ে যা খুশি তাই করতেন। রুপালি গিটার নিয়ে গেয়েছেন গানও। বলেছেন— এই রুপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে/ সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে।

প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু, কারো অনুরোধেই আজ আর অশ্রু গোপন করা সম্ভব নয়। হেমন্তের এই হিমেল ভোরে আমাদের হূদয় শান্ত থাকার কথা ছিল, তা আর থাকল না। কোনোভাবেই এমন হেমন্ত আমরা চাই না। বাঙালির জীবনে কোনোদিন যেন এমন হেমন্ত আর না আসে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads