• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

পরিবেশ

বনায়নেই ধ্বংস হচ্ছে বন

  • শাহনেওয়াজ খান, মধুপুর থেকে ফিরে
  • প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০১৮

বন রক্ষায় নেওয়া সামাজিক বনায়ন কর্মসূচিই এখন বন ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে এ কর্মসূচির মাধ্যমে লাগানো আমাদের জলবায়ুর অনুপযোগী বিভিন্ন প্রজাতির বিদেশি গাছের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে বনের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য।

বনের জন্য ক্ষতির বিষয় হয়ে ওঠা গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি। প্রকৃতিগতভাবে এসব গাছ অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া পাপুয়া নিউগিনি, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এদের নানা প্রজাতির দেখা মেলে। এসব গাছ মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি শোষণ করে। যার ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। মধুপুর বন ও এর আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক ভিত্তিতে এসব প্রজাতির গাছ লাগানোয় ইতোমধ্যে পরিবেশের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বন বিভাগ, বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, গবেষক, মন্ত্রী সবাই এসব প্রজাতির গাছের ক্ষতি স্বীকার করলেও রোপণ বন্ধে অদ্যাবধি কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। 

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব গাছের নিচে স্বাভাবিকভাবে অন্য কোনো গাছ জন্মায় না। কিছু জায়গায় অবশ্য অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করে আনারসের চাষ করা হচ্ছে। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে দ্রুত বর্ধনশীল ইউক্যালিপটাস, আকাশমণিসহ পরিবেশ অনুপযোগী বিদেশি জাতের গাছ লাগানোয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গুল্মলতা-পাতা ও ভেষজ উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্যও। এসব গাছের ফুল, ফল, লতাপাতা পশু-পাখিরা খেতে পারে না। তাই বাগানগুলোয় এখন কোনো পাখি বা পশু দেখা যায় না। এতে তাদের আবাসন সঙ্কটের সৃষ্টি হচ্ছে। গাছগুলো মাটির উর্বরতা শক্তিও হ্রাস করে।

টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ নিশাদ জানান, বন রক্ষার পাশাপাশি স্থানীয়দের জীবনযাপনে আর্থিক সংস্থানের বিষয়টি বিবেচনা করে গাছ লাগানো হয়। সে ক্ষেত্রে দ্রুত আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। বাগানে কোন ধরনের গাছ লাগাতে হবে- এ ব্যাপারে সরকারি স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। বন অধিদফতরের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা করে গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আকাশমণি বা ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো দ্রুত বর্ধনশীল বলে কয়েক বছরের মধ্যেই কেটে বিক্রি করা যায়।

বনের জন্য ক্ষতিকর গাছ কেন লাগানো হচ্ছে— এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) পরিচালক ড. খুরশীদ আকতারকে। তিনি জানান, এ বিষয়ে গবেষণায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সুপারিশ করেছেন তারা। এটা বাস্তবায়ন করা বা না করা বন বিভাগের দায়িত্ব।

১৯৯৫ সালে বন বিভাগ ও সরকারি অন্যান্য সংস্থা বনাঞ্চলে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো নিষিদ্ধের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে। তবে গাছটির কুফল প্রমাণে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান গবেষকরা। গবেষণার আগ পর্যন্ত বনায়ন কর্মসূচির আওতায় তৈরি বাগানে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর সুপারিশ করেন। তবে তা শুধু বসতবাড়ি, রাস্তা, বেড়িবাঁধ ও উডলটে লাগানো যাবে। এ ছাড়া ইউক্যালিপটাসের একক বাগান না করা ও দেশীয় প্রজাতির গাছকে প্রাধান্য দেওয়ার সুপারিশ করা হয় ওই সময়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অধ্যাপক মোহাম্মদ দানেশ মিয়া বলেন, ‘আকাশমণি বা ইউক্যালিপটাসের মতো বেশ কিছু বিদেশি প্রজাতির গাছ আমাদের মাটি ও বনের জন্য ক্ষতিকারক। এগুলো এখনো বনাঞ্চলের আশপাশে লাগানো হয় বলে আমার জানা নেই।’ গাছগুলো নিয়ে সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না এলেও প্রধানমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে বলে জানান তিনি।

মধুপুরের অরণখোলা রেঞ্জের সামাজিক বনায়ন ব্যবস্থা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. জালালউদ্দিন বলেন, ‘সামাজিক বনায়নের ফলে অংশীদাররা আর্থ-সামাজিকভাবে উন্নতির দিকে এগিয়ে গেলেও এতে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।’

অভিযোগ রয়েছে, আকাশমণি বা ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর পেছনে সুফলভোগী কতিপয় ব্যক্তি ছাড়াও বন বিভাগের অনেক কর্মকর্তার আগ্রহ রয়েছে। স্থানীয় নৃগোষ্ঠীদের ব্যবহার করে তারা গাছ বিক্রির বেশিরভাগ টাকা হাতিয়ে নেয়। বনে বাস করা নৃগোষ্ঠীদের ভাগে সামান্য অংশই পড়ে। অভিযোগের বিষয়টি অবশ্য অস্বীকার করেছেন মধুপুরের (টাঙ্গাইল বন বিভাগ) সহকারী বন সংরক্ষক এমএ হাসান।

তিনি মধুপুরে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর কথা অস্বীকার করলেও আকাশমণির কথা স্বীকার করেন। হাসান বলেন, ‘বন বিভাগের অধীনে নয়, ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়ে থাকতে পারে।’ বনের জমিতে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর অভিযোগ পেলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান তিনি।

দোখলা রেঞ্জের কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসমত আলী জানান, আকাশমণি বা ইউক্যালিপটাস গাছ ১০ বছরের মধ্যেই কেটে বিক্রি করা যায়। অন্যদিকে গজারি গাছ বিক্রির উপযুক্ত হতে সময় লাগে ৩০-৪০ বছর। তবে বনের বিষয় বিবেচনা করলে ইউক্যালিপটাসকে ক্ষতিকারক বলে স্বীকার করেন তিনি। অন্যদিকে শালবনে গজারি গাছ আপনা-আপনিই হওয়ায় এগুলোর পেছনে অর্থ বা শ্রম ব্যয় হয় না বলেও উল্লেখ করেন বন বিভাগের এই কর্মকর্তা।

বন সম্প্রসারণ কার্যক্রম ও স্থানীয় দরিদ্র জনগণকে আর্থিকভাবে উপকৃত করতে ১৯৬০ দশকের শুরুর দিকে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি শুরু হয়। ২০০০ সালে এ কার্যক্রম বন আইনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০৪ সালে প্রবর্তন করা হয় সামাজিক বনায়ন বিধিমালা। ২০১০ সালে এটিকে আরো কার্যকর ও যুগোপযোগী করে সরকার। নীতিমালা অনুযায়ী, গাছ বিক্রি করে পাওয়া অর্থ স্থানীয় রক্ষণাবেক্ষণকারী ও বন অধিদফতরের মধ্যে ভাগাভাগি করা হয়।

১৯৯২-৯৩ সালে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বন বিভাগের সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক মডেল উন্নয়নে অন্তর্ভুক্ত হয় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো। উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী নামে আরেকটি সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে ১৯৯৪-৯৫ সালে যুক্ত হয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক।

২০১০ সালের ১১ আগস্ট সামাজিক বনায়নের অগ্রগতিবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি নিয়ে বলেছিলেন, ‘এত দিন বিদেশি দাতা সংস্থার পরামর্শে সামাজিক বনায়নের নামে এ ধরনের গাছ লাগানো হয়েছে। এ গাছের নিচে অন্য কোনো গাছ জন্মায় না, এমনকি পাখিও বসে না। আকাশমণি গাছের রেণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে গেলে অ্যাজমা হয়।’

টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তাও বিদেশি জাতের গাছগুলোর অপকারিতা স্বীকার করে নেন। তবে এ ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত স্থানীয় দরিদ্রদের চাহিদা অনুসারে ও অবস্থা বিবেচনায় কাজ করা হবে বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads