• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

ফািইল ছবি

ফিচার

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের পথিকৃত যারা

  • ফিচার ডেস্ক
  • প্রকাশিত ২৩ এপ্রিল ২০১৮

স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া স্বাধীন জনসমাজ তৈরি হতে পারে না। শৃঙ্খলিত সংবাদপত্র শৃঙ্খলিত জনসমাজেরই প্রতীক। শৃঙ্খলিত জনসমাজের আত্মবিকাশ যেমন অসম্ভব, তেমনিভাবে স্বাধীন ও মর্যাদা বোধসম্পন্ন ব্যক্তি-মানসের স্ফুরণও অকল্পনীয়। এক কথায় স্বাধীন সংবাদপত্রের অস্তিত্ব ছাড়া একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন জাতির অস্তিত্ব কল্পনা করা কষ্টকর। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে তাই প্রতিটি উন্নত ও স্বাধীন দেশেই অলঙ্ঘনীয় বিধান বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনেও সংবাদপত্রের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এ দেশে সংবাদপত্রের ক্রমবিকাশ যাদের হাত ধরে তাদের নিয়েই আজকের আয়োজন। 

 

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে মুসলিম বাংলার ‘সাংবাদিকতার জনক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলা সাহিত্য এবং সংবাদপত্র বিকাশে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৯০ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী দিয়ে কর্মজীবন শুরু। শুধু সাংবাদিক বা সাহিত্যিক হিসেবে নয়, রাজনীতিবিদ হিসেবেও তার অসামান্য অবদান। ছিলেন মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। যুক্ত ছিলেন খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে। জন্মেছিলেন ১৮৬৮ সালের ৭ জুন পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনা জেলায়। সুপণ্ডিত ছিলেন বাংলা, আরবি, উর্দু, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায়। কলকাতার আলিয়া মাদরাসার ছাত্রাবস্থায় নিজের চেষ্টায় ইংরেজি শিখেছেন।

হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী আকরম খাঁ ১৯২২ সালে কলকাতায় চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টি এবং ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্টের প্রতি সমর্থন জানান। ১৯২৬-১৯২৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সমসাময়িক অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে আকরম খাঁ ভারতীয় জাতীয় রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে স্বরাজ্য পার্টি ও কংগ্রেস উভয় দল থেকেই পদত্যাগ করেন। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি কৃষক রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হন। ১৯৩৫ সালে কৃষক রাজনীতি ত্যাগ করে সক্রিয়ভাবে মুসলিম লীগে যোগ দেন। তিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সেন্ট্রাল ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ভারত বিভাগের পর (১৯৪৭) তিনি পূর্ববঙ্গে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। তার রচিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘মোস্তফা-চরিত’ বিখ্যাত। এ ছাড়াও তিনি পাঁচ খণ্ডে পবিত্র কোরআন শরিফের তাফসির করেছিলেন। ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট তিনি মারা যান। ১৯৮১ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।

 

 

আবুল মনসুর আহমেদ

বাংলাদেশের রাজনীতি, সাহিত্য, সংবাদপত্র বিকাশের সঙ্গে আবুল মনসুর আহমেদের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মোহাম্মদী, দি মুসলমান, কৃষক, নবযুগ পত্রিকার সাংবাদিকতা করেছেন। ছিলেন দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক।

এ দেশের রাজনীতি অনেকটা তার হাত ধরেই বেড়ে উঠেছে। মুসলিম থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তার কাছ থেকে রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন। তার লেখা ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বিখ্যাত একটি গ্রন্থ। এ দেশের রাজনীতি ও সমাজবিকাশ বোঝার জন্য অবশ্যপাঠ্য। রাজনীতি ছাড়াও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কংগ্রেস আন্দোলনসমূহের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর তিনি বাংলার মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৪০ সাল থেকে পাকিস্তানের আন্দোলনসমূহের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি ত্রিশাল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী হন। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে তিনি হোসেন শহীদ সোহ‌রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রীও ছিলেন। পূর্ব বাংলার মঙ্গলের জন্য তিনি নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, বিশেষ করে, শিল্পায়নে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। আইয়ুব খানের শাসনামলে তিনি বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেন।

তার রচিত অসংখ্য ছোটগল্প এখনো জনপ্রিয়। সাহিত্যচর্চার জন্য ১৯৬০ সালে পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ১৯৭৯ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। আবুল মনসুর আহমেদ জন্মেছিলেন ১৮৯৮ সালে, মৃত্যু ১৯৭৯ সালে।

 

নূরজাহান বেগম

বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত নূরজাহান বেগম। তিনি জনপ্রিয় সাহিত্যিকও ছিলেন। নূরজাহান ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কন্যা। তিনি উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’-এর সূচনালগ্ন থেকে সম্পাদনার কাজে জড়িত ছিলেন এবং ছয় দশক ধরে পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

নূরজাহান বেগম খুব ছোটবেলায় অনেক বিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তার কারণ সওগাত অফিস ছিল তাদের বাসার দোতলায়, কলকাতার ১১ নম্বর ওয়েসলি স্ট্রিটে। সেখানে নিয়মিত সাহিত্য মজলিস বসত। ওইসব মজলিসে যোগ দিতে আসতেন কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হাবীবুল্লাহ বাহার, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন। এই সাহিত্য মজলিসের নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন নূরজাহান। তাঁর বাবা নাসিরুদ্দীন প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। বেগমের শুরু থেকে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।

তিনি বিয়ে করেন রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইকে। ১৯৫০ সালে তারা বাংলাদেশে চলে আসেন। ঢাকায় এসে বেগম পত্রিকার সঙ্গে নারীদের সংযুক্ত করতে উঠেপড়ে লাগেন। নারীদের লিখতে ও ছবি পাঠাতে উৎসাহ দেন। বলা যায়, তার একক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের মুসলিম নারীদের লেখালেখি ও পত্রিকায় সম্পৃক্ত হওয়ার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়।

২০১৬ সালের ২৩ মে তিনি দেহত্যাগ করেন। পত্রিকা শিল্পে তার অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ‘ইনার হুইল’ ২০১০ সালে তাকে ‘ডিস্ট্রিক্ট-৩২৮’ সম্মাননা প্রদান করে।

 

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এ দেশের গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। আধুনিক সংবাদপত্রের রূপকার। তার সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাক এদেশের সাংবাদিকতাকে আমূল বদলে দিয়েছিল। দেশভাগ পরবর্তী বাংলার রাজনীতি দৈনিক ইত্তেফাকের হাত ধরেই বিকশিত হয়েছে। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম। একই বছর দলটির মুখপত্র হিসেবে আবির্ভাব ঘটে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের। আবদুল হামিদ খান ভাসানী পত্রিকাটির আনুষ্ঠানিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে মানিক মিয়া পত্রিকাটির পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ইত্তেফাককে দৈনিক ইত্তেফাকে রূপান্তরিত করেন। পত্রিকাটি এ সময় আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৫৯ সালে এক বছর জেল খাটেন মানিক মিয়া।

১৯৬৩ সালে তাকে আবারো গ্রেফতার এবং ইত্তেফাকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়। নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার ফলে তার প্রতিষ্ঠিত ঢাকা টাইমস ও পূর্বাণীও বন্ধ হয়ে যায়। গণআন্দোলনের মুখে সরকার ইত্তেফাকের ওপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করলে ১৯৬৯ সালে এটি আবার প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ইত্তেফাকের রাজনৈতিক হালচাল ও পরবর্তী সময়ে মোসাফির ছদ্মনামে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখতেন। ১৯৬৩ সালে তিনি আন্তর্জাতিক প্রেস ইনস্টিটিউটের পাকিস্তান শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গণজাগরণের পেছনে দৈনিক ইত্তেফাক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশের সংবাদপত্র বিকাশে ইত্তেফাকের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। মানিক মিয়া ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ১৯৬৯ সালের ১ জুন।

 

সন্তোষ গুপ্ত 

সাংবাদিক, কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট সন্তোষ গুপ্ত। প্রায় পাঁচ দশক ধরে সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। ‘অনিরুদ্ধ’ কলামের জন্য পাঠক মহলে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সাহিত্য, রাজনীতি, শিল্পকলাসহ সাংবাদিকতার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল তার। কবিতা, শিল্পকলা, চিত্রকলা, রাজনীতি ও সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৪টি। দেশের সব জাতীয় দৈনিকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তার লেখা প্রবন্ধ, কলাম ও সমালোচনামূলক লেখা ছাপা হয়েছে।

দৈনিক সংবাদের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন অনেক দিন। এ ছাড়াও তিনি দৈনিক আজাদেও কাজ করেছেন কিছুদিন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ন্যাপের মুখপাত্র হয়ে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বিভাগে কর্মরত ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত। কমিউনিস্ট মতাদর্শের জন্য বেশ কয়েকবার জেল খেটেছেন তিনি।

৯ জানুয়ারি ১৯২৫ সালে ঝালকাঠি জেলার রুনসী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সন্তোষ গুপ্ত। ছোটবেলা থেকে বইপ্রেমী ছিলেন তিনি। তিনি একনাগাড়ে রবীন্দ্রনাথের ৪৪টি কবিতা মুখস্থ বলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তার শিক্ষককে। সন্তোষ গুপ্ত মৌলিক কবিতা ছাড়াও শেলির কবিতা ও শেক্সপিয়রের সনেট অনুবাদ করেন। অবশ্য সেগুলোর অনেকগুলো ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় লুট হয়ে যায়। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘ইতিহাসের ঝরনাধ্বনি’ ও ‘অনালোকে আলোকস্তম্ভ’।

সন্তোষ গুপ্ত সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য একুশে পদক, শেরেবাংলা পদক, মাওলানা তর্কবাগীশ পদক, জহুর হোসেন স্মৃতি পদকসহ অনেক সম্মাননা লাভ করেন। ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট তিনি মারা যান।

 

সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন 

বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃত সাহিত্য পত্রিকা ‘সওগাত’-এর সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের জন্ম ১৮৮৮ সালের ২০ নভেম্বর চাঁদপুর জেলার পাইকাদী গ্রামে। তার সম্পাদিত সওগাত এবং বেগম পত্রিকা বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবিস্মরণীয়।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার নাসির উদ্দিন সে সময়কার রক্ষণশীল মুসলমান সমাজের অনেক বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে মুসলমান নারী লেখকদের ছবি, তাদের পরিচিতি ও জীবনী এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেখা প্রকাশ করতেন। কলকাতায় ১৯১৮ সালের ২ ডিসেম্বর প্রথম তার সম্পাদনায় সাহিত্য পত্রিকা ‘সওগাত’ প্রকাশিত হয়। এ সময় ব্রিটিশবিরোধী অনেক লেখাই সওগাতে প্রকাশিত হয়। ফলে সর্বমহলে পত্রিকাটি বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। যদিও আর্থিক সঙ্কটের কারণে ১৯২২ সালে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে পরবর্তীতে ১৯২৬ সালে প্রকাশ শুরু হয়ে ১৯৪৭ পর্যন্ত কলকাতা থেকে এর প্রকাশনা অব্যাহত ছিল। দেশ বিভাগের পর ১৯৫৪ সাল থেকে ঢাকায় পুনরায় সওগাত প্রকাশ শুরু হয়। এরই মধ্যে ১৯৪৬ সালে প্রকাশ করেন নতুন সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকা। তার প্রকাশিত দুটি পত্রিকায় সে সময়কার বিখ্যাত লেখকরা লিখতেন। পত্রিকা ও সাহিত্য মজলিশের নিয়মিত লেখকদের মধ্যে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, শামসুন্নাহার মাহমুদ, সুফিয়া কামালসহ অনেকেই।

সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৫), একুশে পদক (১৯৭৭) ও স্বাধীনতা পদক পান। এ ছাড়া তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো, জাতীয় জাদুঘরের বোর্ডের সদস্য ও নজরুল একাডেমির চেয়ারম্যান ছিলেন।

১৯৭৬ সালে তিনি সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের জন্য প্রবর্তন করেন ‘নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক’। ১৯৯৬ সালের ২১ মে ১০৫ বছর বয়সে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন তিনি।

 

 

এস এম আলী

বাংলাদেশের ইংরেজি সাংবাদিকতার দিকপাল ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ আলী। তার হাত ধরেই দেশীয় সাংবাদমাধ্যমে ইংরেজি সাংবাদিকতা শুরু হয়।

ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি মোহাম্মদ আলীর। ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করে করাচি চলে যান। ইভনিং স্টার ও প্রভাবশালী ডন পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। ১৯৫৩ সালে লন্ডন গিয়ে বিবিসিতে কিছুদিন কাজ করেছেন। পাকিস্তান টাইমসে সহ-সম্পাদক পদে কাজ শুরু করেন। এরপর হংকং থেকে প্রকাশিত এশিয়া ম্যাগাজিন পত্রিকায় পাঠানো হয় তাকে। এশিয়া মহাদেশের সাংবাদিক সমাজে জনপ্রিয়তা ছিল সৈয়দ মোহাম্মদ আলীর। এরপর ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই পত্রিকাটি ওই অঞ্চলের সর্বাধিক পঠিত পত্রিকায় রূপ নেয়। এ ছাড়াও তিনি সিঙ্গাপুরের নিউ নেশন, হংকংয়ের হংকং স্টান্ডার্ড-এ কাজ করেছেন। ইউনেস্কোর আঞ্চলিক যোগাযোগ উপদেষ্টা হিসেবে এক যুগ কাজের পর একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা নিয়ে ১৯৯০ সালের শেষ দিকে দেশে ফেরেন মোহাম্মদ আলী। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশ করেন সংবাদপত্র জগতের এক অনন্য তারকা দ্য ডেইলি স্টার।

১৯২৮ সালে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান সিলেট) মৌলভীবাজার মহকুমায় জন্ম মোহাম্মদ আলীর। সৈয়দ মুর্তাজা আলী ও জনপ্রিয় কথাশিল্পী ও রম্যরচয়িতা মুজতবা আলী তার চাচা।

১৯৯৩ সালে তিনি থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। সাংবাদিকতায় অনন্য অবদান রাখার জন্য ১৯৯৫ সালে এস এম আলীকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

 

এবিএম মূসা

বাংলাদেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকদের মধ্যে যাদের নাম উচ্চারিত হয় তাদের মধ্যে এবিএম মূসা অন্যতম। জনপ্রিয় কলাম লেখক এবিএম মূসা একজন দর্শকপ্রিয় আলোচক এবং সংবাদ বিশ্লেষক হিসেবেও ছিলেন সমান জনপ্রিয়। বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে তিনি কাজ করে গেছেন নির্ভিক চিত্তে।

১৯৩১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে কলেজে অধ্যয়নকালে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। দৈনিক ইনসাফে যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদপত্র জগতে কর্মজীবন শুরু করেন। সে বছরই যোগ দেন ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি এ পত্রিকায় রিপোর্টার, স্পোর্টস রিপোর্টার ও বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদদাতা হিসেবে তিনি রণাঙ্গন থেকে সংবাদ প্রেরণ করতেন। বিবিসি, সানডে টাইমস প্রভৃতি পত্রিকায় সে সময় সংবাদ প্রেরণ করেছেন তিনি।

এবিএম মূসা দীর্ঘ ৬৪ বছর সাংবাদিকতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি জাতিসংঘের পরিবেশ কার্যক্রমের (এসকাপ) এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক পদে যোগ দেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন।

সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ১৯৯৯ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি অর্জন করেছেন আরো কিছু পুরস্কার, এর মধ্যে জেফারসন ফেলোশিপ (১৯৭০), কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়ন ফেলোশিপ (১৯৬১) উল্লেখযোগ্য। জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবিএম মূসা ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

 

এমআর আখতার মুকুল

‘কি পোলারে বাঘে খাইলো? শ্যাষ। আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ।’ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর বিজয়ের দিনে চরমপত্রের শেষ পর্বে এভাবেই ইতি টানেন এমআর আখতার মুকুল। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চরমপত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপনা ও সাহস জুগিয়েছিলেন তিনি। একটি হালকা ভাঙা কণ্ঠ, অসাধারণ শব্দচয়ন ও অনন্য বাচনভঙ্গিতে মুক্তিকামী বাঙালিকে উৎসাহিত করত সেই চরমপত্র।

এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা, উত্তরবঙ্গের ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে গল্প ও হাসি-ঠাট্টার ছলে দুরূহ রাজনীতি ও রণনীতির ব্যাখ্যা ছাড়াও রণাঙ্গনের সর্বশেষ খবরাখবর উপস্থাপন করতেন এমআর আখতার মুকুল। সব শ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে চরমপত্র।

৯ আগস্ট ১৯৩০ বগুড়ায় জন্ম নেওয়া এমআর আখতার মুকুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি নেন। ইত্তেফাকের সূচনালগ্ন থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ইউডিআই ঢাকাস্থ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি বেশকিছু পত্রিকায় কাজ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি রেডিও বাংলাদেশের প্রধান এবং পরবর্তী সময়ে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় ২০০১ সালে তাকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করা হয়। স্বনামধন্য এই সাংবাদিক ২০০৪ সালের ২৬ জুন পরোলোকগমন করেন।

 

হাবিবুর রহমান মিলন

বাংলাদেশের খ্যাতনামা সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলন ১৯৩৫ সালের ২৩ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার উচালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে ১৯৬৫ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন হাবিবুর রহমান মিলন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ও দৈনিক ইত্তেফাকের উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। সন্ধানী ছদ্মনামে দৈনিক ইত্তেফাকে তার নিয়মিত কলাম ছিল ‘ঘরে-বাইরে’। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রবীণ সদস্য ছিলেন।

হাবিবুর রহমান মিলনের সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ১৯৬৩ সালে। দৈনিক সংবাদে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতায় তার অভিষেক ঘটে। এক দুর্ঘটনায় তার বড় ভাই দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক আহমেদুর রহমানের মৃত্যু হলে তিনি সহকারী সম্পাদক হিসেবে ওই পত্রিকায়ই যোগ দেন। ভিমরুল ছদ্মনামে তার কলাম সে সময় যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় ছিল।

কর্মজীবনে তিনি দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পয়গাম, দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করেছেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি সাংবাদিকতার জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন। বেশ কয়েকটি বইও রচনা করেছেন তিনি। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে ‘তরঙ্গ নীল রাত্রি’ (উপন্যাস), ‘মহিলা বিজ্ঞানী’, নির্বাচিত কলাম ‘ঘরে-বাইরে’ এবং ‘দারিদ্র্য ও মানবতা’। দীর্ঘদিন কিডনি ও ফুসফুসে জটিলতাসহ নানা রোগে ভুগে ২০১৫ সালের ১৪ জুন রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

কে জি মুস্তাফা

১৯২৮ সালে সিরাজগঞ্জের কুড়িপাড়ায় জন্ম। উচ্চ মাধ্যমিকে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হলেও সেখানকার পড়াশোনা রেখে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনার সময়ই কলকাতার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও মাত্র তিন মাসের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটে সহযোগিতা করার জন্য বহিষ্কৃত হন। যদিও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ ডিগ্রি এবং ১৯৫৭ সালে একই বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দৈনিক আজাদ পত্রিকাটি ঢাকায় চলে এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও পুনরায় আজাদ পত্রিকায় চাকরি নেন মুস্তাফা। পরবর্তীতে তিনি দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক পূর্বকোণ ও সংবাদ পত্রিকায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।

নব্বই দশকের শেষ দিকে তিনি দৈনিক মুক্তকণ্ঠ পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তান ফেডারেল জার্নালিস্টস ইউনিয়নের সভাপতি এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।

এ ছাড়াও সাপ্তাহিক ইরাক টুডে ও ডেইলি বাগদাদ পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবেও তিনি কাজ করেন। সাংবাদিক নেতা হিসেবেও তিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা থাকায় তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত লেবানন এবং ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১০ সালে ১৩ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads