• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
বাংলায় সূফীবাদ

বঙ্গদেশে আগত প্রথম সূফী বাবা আদম

প্রতীকী ছবি

ফিচার

বাংলায় সূফীবাদ

  • কামরুল আহসান
  • প্রকাশিত ২৮ মে ২০১৮

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার হয়েছে সূফী মরমিবাদের হাত ধরে। সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.) এবং তার অনুসারীদের হাত ধরেই ইসলামের তাওহিদের বাণী সারা বাংলার গ্রামে গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। তবে হজরত শাহজালাল (র.)-এর আগেও এদেশে কয়েকজন সূফী দরবেশ এসেছিলেন বলে জানা যায়। বঙ্গদেশে আগত প্রথম সূফী বাবা আদম। এ কথা জানিয়েছেন সূফী গবেষক ড. মুহম্মদ এনামুল হক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সূফীবাদ নিয়ে কাজ করেছেন। তার রচিত ‘বঙ্গে সূফী প্রভাব’ গ্রন্থটিই বাংলা ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ সূফী গবেষণামূলক বই। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে, ১৯৩৫ সালে। বইটিতে ড. এনামুল হক বলেন, ‘বাবা আদমের পর ময়মনসিংহের শাহ মুহম্মদ সুলতান রুমীর (১০৫৩ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গে আগমন। ইহাদের পর সুহরবর্দীয় সম্প্রদায়ের শায়খ জালালউদ্দীন তাবরীজীর (মৃত্যু-১২২৫ খ্রি.) আগমনের পর থেকে বঙ্গে বন্যাপ্রবাহের ন্যায় সূফী-প্রভাব পড়তে আরম্ভ করে।’

এর পর সূফীবাদ নিয়ে আরো অসংখ্য কাজ হয়েছে। ড. আহমদ শরীফ বাংলার সূফী সাহিত্যের ৯টি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। সেটিও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। বইটিতে আহমদ শরীফ স্থান দিয়েছেন মীর সৈয়দ সুলতান কৃত- জ্ঞানচৌতিশা, শেখ চাঁদ কৃত- হরগৌরী সম্বাদ ও তালিবনামা, অজ্ঞাত এক কবি কৃত- যোগ কলন্দর, হাজী মুহম্মদ কৃত- সুরতনামা বা নূরজামাল, মীর মুহম্মদ শফী কৃত- নূরনামা, শেখ মনসুর কৃত- আগম ও জ্ঞান সাগর এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত- জ্ঞান সাগর। এই গ্রন্থগুলোর মধ্যে মধ্যযুগে বাংলার সূফীসাহিত্য বিকাশের একটি ধারা খেয়াল করা যায়।

সূফীবাদ একটি বিরাট জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়। সংক্ষেপে এর আলোচনা দুরূহ ব্যাপার। তা ছাড়া বিষয়টি বিতর্কিতও। বিশেষত, আমাদের বর্তমান সমাজে ধর্ম ও ধর্মীয় যেকোনো বিষয় নিয়ে কথা বলাটাই একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। তবু পরমের সন্ধানে মানুষের যাত্রা থেমে থাকে না। এর জন্য অনেক মরমিসাধক প্রাণও দিয়েছেন।

সূফী শব্দটি নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। শব্দটির প্রকৃত অর্থ কী, তা নিয়েও একমত হওয়া সহজ নয়। কেউ মনে করেন, সূফী আরবি শব্দের সফা থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ পবিত্রতা। কেউ কেউ বলেন, গ্রিক ফিলোসফিয়া শব্দ থেকে সূফী শব্দের আগমন- যার অর্থ দাঁড়িয়েছে জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা। কেউবা বলেন, সূফী আরবি সূফ শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ পশম। প্রকৃত সূফী কে- তা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। ঠিক কী কী গুণ থাকলে একজন সাধককে সূফী বলা যায়? যেকোনো মতপথের মতোই এই নিয়েও আছে বহু মত। তবে হাজার বছরের তর্কে-বিতর্কে এ সত্য আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যে মানুষ বিষয়-ভাবনা ছেড়ে পরমের সন্ধানে নিজেকে সঁপে দেন এবং একই কাপড় পরিধান করার কারণে তা ছিঁড়ে যায়, পথে পথে ঘুরে যিনি ভিক্ষা করে খান, যিনি নিজের সব অহং বিসর্জন দিয়েছেন, নিজেকে পর্যন্ত ভুলে যিনি একত্ববাদের নূর তাজাল্লির সঙ্গে এক হয়ে গেছেন, তিনিই সূফী। বিখ্যাত সূফীসাধক জুনাইদ বাগদাদি সূফীর আটটি গুণের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর মতো ত্যাগ, হজরত ইসমাইল (আ.)-এর মতো আনুগত্য, হজরত আইয়ুব (আ.)-এর মতো ধৈর্য, হজরত জাকারিয়া (আ.)-এর মতো বাকসংযম, যোহানের মতো আত্মপীড়ন, হজরত ঈসা (আ.)-এর মতো ভোগবিমুখতা, হজরত মুসা (আ.)-এর মতো পশমী পরিধেয় গ্রহণ এবং হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দারিদ্র্য বরণ।

এই সূফীবাদেরও বহু মতপথ বর্তমান। বাংলাদেশে সূফীবাদের প্রধানত চারটি ধারা-(ক) চিশতিয়া, (খ) নকশবন্দিয়া, (গ) কাদেরিয়া এবং (ঘ) সোহরওয়ার্দীয়া। এর সঙ্গে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা-মত-উপমতের আবির্ভাব হয়েছে কালের বিবর্তনে। তার সঙ্গে মিশে গেছে নানা অঞ্চলের নানা আচার। মৌলিক সূফীবাদ বলে কোনো বিষয় নেই।

সূফীবাদের সামগ্রিক পরিচয় দেওয়া আমাদের লক্ষ্য নয়, স্বল্প পরিসরে সেটা সম্ভবও নয়। আমরা শুধু চেয়েছি নানাদিকে একটু ইঙ্গিত করতে। বাংলায় সূফীবাদের প্রভাব নিয়ে তাই আমাদের এবারের ‘আমার বাংলার’ আয়োজন, ‘বাংলায় সূফীবাদ’।

বর্তমানে যে যে মতপথের অনুসারীই হোক, বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে সূফীবাদের প্রভাব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। হাজার বছর ধরে এ দেশের মানুষের কালেকটিভ কনসাসনেসে সূফীবাদের প্রভাব পড়েছে। তার সঙ্গে অনেক বৌদ্ধ-হিন্দুধর্মের যোগতন্ত্র মিশেছে তাও সত্য। তবু আমাদের সারা বাংলায় মৌখিকভাবে যে সহজিয়া দর্শনের বিকাশ তা সূফীবাদের হাত ধরেই। সূফীবাদের ইতিহাস পাঠ করা তাই আমাদের অস্তিত্বের মূল ইতিহাসই পাঠ করা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads