ঐতিহাসিক রূপরেখায় দিনাজপুর একটি অতি প্রাচীন জেলা। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুবই চমকপ্রদ। নবাবী আমল থেকে ব্রিটিশ শাসন আমল পর্যন্ত এবং পাকিস্তান আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত এই জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি বহুলাংশে বিস্তৃতি লাভ করে। সিপাহি বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ভারত ছাড় আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্বগাথা এই জেলার ইতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। দিনাজপুর জেলায় অসংখ্য কৃতী ও স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম দিনাজপুরের মহারাজা স্যার গিরিজানাথ রায়বাহাদুর, মহারাজা জগদীশনাথ রায়বাহাদুর, যোগীন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, পীর শাহ সুফি মতলুব মিয়া, গিরিশ চন্দ্র চক্রবর্তী, খানবাহাদুর একিন উদ্দীন আহমেদ, মাধব চন্দ্র চট্টপাধ্যায়, প্রেমহরি বর্মণ, কিংবদন্তি নাট্যজন শিবপ্রসাদ কর, ডা. সুকুমার সেনগুপ্ত, খানবাহাদুর মাহাতাব উদ্দীন আহমেদ, গোলাম রব্বানী আহমেদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, বরদা ভূষণ চক্রবর্তী, হাসান আলী, মো. হেমায়েত আলী টিকে, মির্জা কাদের বকস, জয়নব রহিম, খানবাহাদুর মির্জা আমিনুল হক, ডা. মফিজউদ্দীন আহমেদ, হাজী আবদুর রৌফ, রহিম উদ্দীন আহমেদ, অধ্যক্ষ তসির উদ্দীন আহমেদ, এসএ বারী এটি, অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী, কণ্ঠশিল্পী সতীশ চন্দ্র সরকার, শহীদ মেজর মাহবুব বীরউত্তম, মো. আজিজার রহমান এমএলএ, এম. আবদুর রহিম অ্যাডভোকেট, শাহ মাহতাব উদ্দীন এমএলএ, দুর্গা মোহন রায় এমএলএ, মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু, শাহজাহান শাহ, কাজী আবদুল মজিদ চৌধুরী এমপিসহ বিশিষ্টজনরা। সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও দিনাজপুর পিছিয়ে ছিল না কখনো। দিনাজপুরে সাঁওতালসহ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস সেই প্রাচীনকাল থেকেই। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আরো সমৃদ্ধ করেছে দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে। রাজনৈতিক সব আন্দোলনের অগ্রভাগেই ছিল দিনাজপুরের অসংখ্য বীর সেনানী। দিনাজপুরের জমি অত্যন্ত উর্বর। দিনাজপুরের যে ক’টি নদী আছে তা দিনাজপুরের শস্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। স্থানীয় প্রজাতির মাছ ও বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মৎস্য সম্পদেও সমৃদ্ধ এখন দিনাজপুর জেলা। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্প বিকাশ লাভ করছে বিরতিহীনভাবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়নে বিসিক দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এ ছাড়াও দিনাজপুরের যুব সমাজ এখন কর্মমুখী আগের তুলনায়। আইসিটি সেক্টরে দিনাজপুর এগিয়ে যাচ্ছে অন্য জেলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। পর্যটন শিল্পেও দিনাজপুর এখন অনেক উন্নত।
সরকারি পর্যটন মোটেলসহ অসংখ্য আবাসিক হোটেলে পরিপূর্ণ এখন দিনাজপুর জেলা। আর পর্যটন স্পট এখন দিনাজপুরে খুবই সমৃদ্ধ। যে কোনো দেশি বা বিদেশি পর্যটক মাত্রই পছন্দের তালিকায় দিনাজপুর জেলাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বাংলাদেশে এখন দিনাজপুরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য আলাদা কোনো পরিচিতির দরকার পড়ে না। চাল-লিচুতে ভরপুর জেলার নাম দিনাজপুর এখন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দিনাজপুরের সমৃদ্ধিশালী প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ। আম চাষেও এগিয়ে যাচ্ছে এখন দিনাজপুর। দিনাজপুরের পাপড় শিল্প এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে স্থান করে নিয়েছে। এ ছাড়া দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মিষ্টি শিল্প সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে দিনাজপুরের এখন কমন ব্র্যান্ড চাল-লিচুতে ভরপুর জেলার নাম দিনাজপুর।
দিনাজপুর জেলা চাল, লিচু এবং আম উৎপাদনের জন্য পূর্বে থেকেই বিখ্যাত। দিনাজপুরের দর্শনীয় স্থান হলো কান্তজিউ মন্দির (শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত), রামসাগর (শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত), রাজবাড়ী ইত্যাদি। দিনাজপুর জেলা লিচুর জন্য বিখ্যাত। এ জেলায় বাংলাদেশের সেরা লিচু উৎপন্ন হয়। এ জেলায় উৎপন্ন হওয়া বিভিন্ন জাতের লিচুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বেদানা, মাদ্রাজি, বোম্বাই ও চায়না-৩। এ জেলায় নানাজাতের সুগন্ধি ধান জন্মে। তার মধ্যে কাটারিভোগ, ব্রিধান-৩৪, জিরা কাটারি (চিনি গুঁড়া), ফিলিপিন কাটারি, চল্লিশাজিরা, বাদশাভোগ, কালোজিরা, জটা কাটারি, চিনি কাটারি, বেগুন বিচি ও ব্রিধান-৫০ উল্লেখযোগ্য।
দিনাজপুরের কৃষি বিভাগ এবং জেলা প্রশাসনসহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে ঐতিহ্যবাহী ব্র্যান্ডকে আরো বেশি সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। দিনাজপুরের আপামর জনসাধারণ এই ব্র্যান্ড নিয়ে গর্বিত।
বিশেষ সাক্ষাৎকার
বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন অব্যাহত রয়েছে
ড. আবু নঈম মুহাম্মদ আবদুছ ছবুর
জেলা প্রশাসক, দিনাজপুর
প্রাচীনতম জেলাগুলোর অন্যতম দিনাজপুর। ইতিহাস-ঐতিহ্যে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ এ জেলা। চাল ও লিচুতে ভরপুর জেলার নাম দিনাজপুর- এ ব্র্যান্ডকে সমৃদ্ধিশালী করতে বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন অব্যাহত রয়েছে। দিনাজপুর জেলায় খাদ্যশস্যের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্প উৎসাহিত করতে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের গৃহীত এসব উন্নয়ন সর্বত্রই দৃশ্যমান। মহান মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুরবাসীর রয়েছে বিশাল আত্মত্যাগ। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূলে দিনাজপুর জেলা প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। দিনাজপুর জেলার সুশীল সমাজকে সঙ্গে নিয়ে জেলার উন্নয়নে সার্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বহু মাদক ব্যবসায়ী স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে
মো. হামিদুল আলম, বিপিএম
পুলিশ সুপার, দিনাজপুর
প্রাচীন জনপদের বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠে ঘেরা, আম-লিচুতে ভরপুর দিনাজপুর জেলা। এখানকার জনগণও সহজ-সরল ও উদার প্রকৃতির। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও উন্নত এবং পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের পর থেকেই আমার নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলা পুলিশ মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে এবং শতভাগ না হলেও ক্ষেত্রবিশেষে ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ সফল হয়েছে। ফলে মাদক এখন প্রায় শূন্যের কোটায়। দুই হাজারের বেশি মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। আমার অনুরোধ, আপনাদের সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখুন তারা যেন জঙ্গি, মাদক ও সন্ত্রাসের কবল থেকে দূরে থাকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ জেলাকে একটি মডেল জেলায় রূপান্তরিত করতে চাই।
দলমত নির্বিশেষে সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই
সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম
মেয়র, দিনাজপুর পৌরসভা
দিনাজপুর জেলা যেমন প্রাচীন, তেমনি পৌরসভার ইতিহাসও প্রাচীন। পৌরসভার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের অভাবে মাঝেমধ্যে পৌরবাসী কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে দিনাজপুর পৌরসভায় সরকারের বরাদ্দ অন্যান্য পৌরসভার মতো। তবে এবার সরকারি বরাদ্দ কাঙ্ক্ষিত আকারে পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। দিনাজপুর পৌরসভার জনগণ বিভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন পৌরসভার মাধ্যমেই আশা করে। দিনাজপুর পৌরসভা তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে জনগণের সেই কাঙ্ক্ষিত আশা পূরণে। নান্দনিক পৌরসভা গঠনে দলমত নির্বিশেষে সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই।
নদীগুলোর নাব্য ফিরিয়ে আনতে আশু উদ্যোগ নিন
আবুল কালাম আজাদ
সভাপতি, নাগরিক উদ্যোগ, দিনাজপুর
দিনাজপুর জেলার প্রাচীনতা এবং এর কৌলীন্য বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা থেকে স্বতন্ত্র। এ জেলার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি আরো বেশি বেশি হোক, এটি চাওয়াই স্বাভাবিক। দিনাজপুর জেলার আপামর জনসাধারণ জেলার উন্নয়নে সংগঠিত হয়ে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। কাটারিভোগ চাল ও লিচুতে সমৃদ্ধ দিনাজপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য আমাদের অহংকার। মহান মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুরবাসীর অবদান অনেক বেশি। শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়নে দিনাজপুরকে আরো এগিয়ে নিতে চাই কার্যকর কর্মপরিকল্পনা এবং এর সফল বাস্তবায়ন। মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস মোকাবেলায় দিনাজপুরের আপামর জনসাধারণ এখন এক কাতারে। সরকারের প্রতিশ্রুত উন্নয়ন সবকিছুই দিনাজপুরে বাস্তবায়িত হোক- এটাই প্রত্যাশা।