• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ক্যাম্পাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেয়ালিকা

দেয়ালিকা

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

ক্যাম্পাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেয়ালিকা

  • প্রকাশিত ২২ অক্টোবর ২০১৮

সুখী আক্তার

বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তির যুগে দেয়ালিকা আর আগের অবস্থানে নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে বাড়তি আর কিছু নিতে রাজি নয়। দেয়ালিকা যে সৃজনশীলতার অন্যতম মাধ্যম- এই ধারণা দিনে দিনে ক্যাম্পাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে ঢুকলে এখন আর চোখে পড়ে না দেয়ালিকা। হাইস্পিড ইন্টারনেট ব্যবহারে দুনিয়া এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। দেয়ালিকাকে অনেকে ডাকে দেওয়াল পত্রিকা নামে। এক যুগ আগের কথা, দেয়ালিকার প্রচলন ছিল চোখে পড়ার মতো। তখন ক্যাম্পাসগুলোয় ঢুকলে চোখে পড়ত আর্টপেপারে কার্টুন আর হাতে লেখা দেয়ালিকা। দেয়ালিকা হলো ক্যাম্পাসের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সৌন্দর্য। অ্যাসাইনমেন্ট আর প্রেজেনটেশনের বাইরের শিক্ষার্থীরা এখন অন্য কিছু করতে আগ্রহী নয়। জিপিএ-৫ বাড়ছে, কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে আর কিছু বাড়ছে না।

একটা সময় ছিল যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক লেখাপড়ার বাইরে শিক্ষার্থীদের দক্ষতার দিকে বেশি দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কেউ খেলাধুলা, কেউ সাংস্কৃতিক অঙ্গন, কেউ সাহিত্য, কেউ বিতর্ক, বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখালেখিসহ নানা কিছু নিয়ে তাদের ভেতরের লালিত প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের উৎসাহ দিতেন। এরই অংশ দেয়ালিকা। কখনো বলা হতো দেয়াল পত্রিকা বা ম্যাগাজিন। কোনো বিষয় সম্পর্কে কার্টুন, ছবিসহ লেখার মধ্য দিয়ে পুরো বিষয়ের গভীরতা এক নজরে সবার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। নাটক যেমন দর্শকদের কাছে অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। ঠিক তেমনি নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপনের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম হলো দেয়ালিকা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একজন অধ্যাপক বলেন, দেয়ালিকার আবেদন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষার্থীরা পুঁথিগত অনেক কিছু নিতে চায় না। তারা অ্যাসাইনমেন্ট টাইপ করতে পছন্দ করে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস করতে বেশি আগ্রহী। আবার কেউ যদি বোর্ডে লিখে লেকচার দিল, কিন্তু নোট করতে চাইবে না শিক্ষার্থীরা। হাতে লেখার মধ্যে যে আবেগ, আনন্দ, ভালোবাসা কাজ করে তার সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। একাডেমিক বা বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনার বাইরে আর কিছু হচ্ছে না। বহু যুগ পরও সবার মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি থেকেই যাবে।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মুহাম্মদ আলী নকি বলেন, যতই দিন যাচ্ছে বড় পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। দেয়ালিকা প্রকাশের মাধ্যমে বাইরের ও মনের ভেতরের দেয়ালটা ভেঙে ফেলতে হবে। কারণ দেয়াল পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। ফেসবুকের যুগে এসব সৃজনশীল কাজ আর হয় না। কিন্তু আমি নিজে দেয়ালিকা লিখেছি। এখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়াল পত্রিকা হারিয়ে গেছে। পাঠ্যাভ্যাস, সাংস্কৃতিক বোধ ও সহনশীলতা বোধ তৈরিতে সাহায্য করে দেয়ালিকা। প্রযুক্তির এই যুগে এখন আর কারো সহনশীলতা নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সতেজ রাখার জন্য বছরের বিশেষ দিনগুলোতে দেয়ালিকা প্রতিযোগিতা ও প্রকাশ করা প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সায়মা সুলতানা মুন বলেন, কলেজজীবনে প্রথম যখন পানিদূষণের ওপর দেয়ালিকা তৈরি করতে বসেছি, তখন গ্রুপের সবাই একটু নার্ভাস হয়ে যাই। পরে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিবেদন, ছবি দিয়ে দেয়ালিকাটি শেষ পর্যন্ত তৈরি করতে পারি। বর্তমানে অ্যাসাইনমেন্ট, ভাইভা আর প্রেজেনটেশন দিতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো অবধি পাইনি আমি। মনে হয় দেয়াল পত্রিকা ক্যাম্পাস থেকে উঠে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, একটা সময় নিয়মিত চিঠি লিখতাম। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতাম। কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল যুগে দেয়ালিকা কম প্রকাশ হওয়ায় আমরা হারিয়ে ফেলেছি নিজস্ব সৃষ্টি। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় সৃষ্টিশীলতা। তার সঙ্গে রয়েছে সৃজনশীলতা ও স্বপ্ন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসে অন্তত একবার প্রকাশ দরকার দেয়ালিকা। 

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবিহা স্বর্ণা বলেন, বিজ্ঞানের এই যুগে দাঁড়িয়ে জয়গান করছে নতুন সময়। এই সময়ে দাঁড়িয়ে দেয়ালিকা লেখা ও প্রদর্শন করা অনেকের কাছে নিছক সময় ব্যয়ের বিষয় হতে পারে। কিন্তু হাতের ছোঁয়ায় যে সৃজন জড়িত তা কখনো পুরান নয়, হারানোর নয়, বরং হতে পারে নতুন ভাবনার উদয়স্থল।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads