• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
নিরাপদ সড়ক যেন ছেলেভোলানো গল্প

নিরাপদ সড়ক যেন ছেলেভোলানো গল্প

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

নিরাপদ সড়ক যেন ছেলেভোলানো গল্প

  • মোহাম্মদ আবু নোমান
  • প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০১৯

বাংলাদেশের মানুষের জীবন আজ কিছু অর্থলোভী বাসের মালিক, বিআরটিএ’র কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও ড্রাইভারদের হাতে জিম্মি! তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এমন মেধাবী তরতাজা একটা জীবন পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণি পাস মাতাল ড্রাইভারের হাতে যেতে পারে? জেব্রা ক্রসিং কী, জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ির গতি কমাতে হয়, অধিকাংশ ড্রাইভার তাও জানে না। তাহলে এরকম জেব্রা ক্রসিং দিয়ে কী লাভ? এজন্য সব জেব্রা ক্রসিংয়ের আগে স্পিড ব্রেকার দেওয়া জরুরি। নিয়ম মেনেই তো জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল আবরার।

অপরদিকে নিয়ম ভেঙে সুপ্রভাত বাসের চালক অন্য একটি বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আবরারকে প্রথমে ধাক্কা ও পরে চাপা দিয়ে খানিকটা টেনেও নিয়ে যায়। এতে প্রাণ চলে যায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।

পথচারী পারাপারের জন্য ব্যস্ত রাস্তায় আড়াআড়ি সাদা-কালো ডোরাচিহ্নিত দাগ দেওয়া নির্দিষ্ট অংশ জেব্রা ক্রসিং নামে পরিচিত। সাধারণত স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বা যেখানে পাবলিক সমাগম বেশি থাকে, সেখানে মানুষ যাতে সহজে রাস্তা পারাপার হতে পারে সেজন্যই জেব্রা ক্রসিং দেওয়া হয়। নিয়ম হলো, জেব্রা ক্রসিংয়ের সামনে চালক গাড়িটিকে একটা নির্দিষ্ট গতিসীমার নিচে নিয়ে আসবে, যাতে পথচারী সহজেই রাস্তা পার হতে পারে। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ জেব্রা ক্রসিং তিন রাস্তা, চৌরাস্তা অথবা রাস্তার মোড়ে দেওয়া হয়েছে চলাচল সুগম করতে। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ যানবাহন চালক কোনো তোয়াক্কাই করছে না জেব্রা ক্রসিং।

আধুনিক শহরগুলোতে রাস্তা পারাপারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় জেব্রা ক্রসিং। আবার পারাপারের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে পদচারী সেতুও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ঢাকার মতো জনবহুল নগরের পদচারী সেতুগুলো নারী, শিশু, অসুস্থ, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী কিংবা ভারী ব্যাগ বহনকারীদের জন্য উপযোগী নয়। এগুলো যথাযথ স্থানেও তৈরি হয়নি। ফলে নাগরিকদের মধ্যে পদচারী সেতু ব্যবহারে অনীহা দেখা যায়। এ ছাড়া পদচারী সেতুর উচ্চতা, নোংরা পরিবেশ, হকার ও মাদকসেবীদের দখল করে রাখা, সবকিছু মিলে এই সেতু পথচারীদের জন্য অনিরাপদ। এজন্য মানুষ নিরাপদে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে সড়ক পার হতে চায়।

যারা বা যাদের এই কাজগুলো নিয়ে চিন্তা-ফিকির করার ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, টাকার গন্ধে তাদের মগজে পচন ধরে গেছে। তাই আজকাল কিছু বললেও খুব বেশি একটা কাজ হয় না। রাস্তায় অহরহ গাড়ি চালকের নিয়ম ভাঙার ভয়াবহ প্রতিযোগিতা চলছেই। এদের লাগাম টেনে ধরার কেউ যেন নেই।

রাস্তায় গাড়ির ওভারটেকিং, কতটুকু নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পাশাপাশি চলতে হবে, এ জন্যে কঠোর বিধি-বিধান করে তা কার্যকর করা যায় না? ইতোপূর্বে একই রুটে জাবালে নূর পরিবহনও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এখনো সদম্ভে চলছে। বাস মালিক চক্র কি এতই শক্তিশালী? আর কত প্রাণহানি ঘটিয়ে মালিক ও ড্রাইভারচক্র ক্ষান্ত হবে? আর কত প্রাণ গেলে নিরাপদ সড়ক পাবে জাতি?

রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বাসচাপায় শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার জেরে সেখানে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়ে অবরোধ তুলে নেওয়ার অনুরোধ, সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিতকরণ, সুপ্রভাত পরিবহনের কোনো বাস ওই রুটে চলতে না দেওয়া ও নিহত আবরারের নামে সেখানে তিন-চার মাসের মধ্যে একটি পদচারী সেতু নির্মাণ করে দেওয়া হবে জানালেও তাতে সাড়া দেননি অবরোধকারীরা।

আবরারের জীবনের বিনিময়ে তার নামে একটি ফুটওভার ব্রিজ কি অনেক বড় কিছু? এত সস্তা মানুষের জীবন? কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও বোঝে— এগুলো ছেলেভোলানো কথা। বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত। মেয়র যত সাবলীলভাবেই বলুক না কেন, দেশে এসব বাস্তবায়ন অত সহজ নয়।

প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা কথা বলে কোনো খারাপ ফল ভোগ করতে হয় না বলেই আজ সত্যের এত আকাল। নিয়ম না মানা দানবের জিম্মায় পরিবহন সেক্টরকে রেখে রাষ্ট্র কীভাবে দুর্ঘটনা প্রশমন করবে? এজন্য পাবলিক পরিবহন সেক্টরে অরাজকতার দায় সরকারকেই নিতে হবে। রাস্তা আটকিয়ে প্রতিবাদ করা যদিও সর্বসাধারণের জন্য কষ্টের কারণ; কিন্তু কারো আপনজন যখন এমন দুর্ঘটনায় পতিত হন, তাদের অবস্থান থেকে মেনে নেওয়াও যায় না।

বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানানো হয়েছে, ‘মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর ৪৩ ধারা মোতাবেক ঢাকা- মেট্রো-ব-১১-৪১৩৫ নং বাসের রেজিস্ট্রেশন সাময়িকভাবে বাতিল করা হলো।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, গাড়িটি কি নিজে নিজেই এসে আবরারকে চাপা দিয়েছে? মনে হয় বাসের কোনো চালক ছিল না! তাই বাসের নিবন্ধন বাতিল! পরে নতুন নামে নিবন্ধন হবে! বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কিছু উপরি কামাইও হবে। আগামীতে আর অ্যাক্সিডেন্টও হবে না! সরকার বা প্রশাসন সড়কে হত্যাগুলোর যথাযথ বিচার, গাড়ি ও চালকের লাইসেন্স এবং ফিটনেস যথাযথ পরীক্ষা করলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে আসত।

রাস্তায় যাত্রী নেওয়ার জন্য বাস চালকদের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, এটা কোনো সভ্য মানুষের কাজ নয়। কোনো সভ্য দেশে এরকমটা চলতে পারে না। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে দক্ষ গণপরিবহন চালক তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। না হয়তো এভাবে রাস্তায় মানুষ খুন চলতেই থাকবে। কারণ আমাদের পরিবহন সেক্টরটা পুরোপুরি অদক্ষ ও অমানুষদের হাতে চলে গেছে। আর সর্বসাধারণ প্রতিনিয়ত এমন অনিরাপদ সড়কে চলাচল করছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, অনেক হয়েছে, এবার কার্যকর ব্যবস্থা নিন। সরকার বা প্রশাসনের চেয়ে ক্ষমতাবান যে কেউই নয়, এটা বাস মালিক ও শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা করুন।

 

লেখক : সাংবাদিক

ধনঁহড়সধহ১৯৭২—মসধরষ.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads