• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ইলা মিত্র ও তেভাগা আন্দোলন

ইলা মিত্র

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

ইলা মিত্র ও তেভাগা আন্দোলন

  • মো. জোবায়ের আলী জুয়েল
  • প্রকাশিত ০৭ এপ্রিল ২০১৯

বাংলাদেশের কিংবদন্তি নারী, বিপ্লবী চেতনার প্রতীক, নাচোলের মাঠে, কৃষকের ঘরে মূর্তিমতি রানি-মা, জোতদারের ত্রাস, মুসলিম লীগ সরকারের চক্ষুশূল বাঙালির গর্ব ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, অবিভক্ত বাংলার ডেপুটি অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। মা মনোরমা সেন। তিন বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে ইলাই ছিলেন জ্যেষ্ঠ।

জীবনের গোড়ার দিকে ইলা মিত্র গোটা ভারতবর্ষের দৃষ্টি কেড়েছিলেন কৃতী ক্রীড়াবিদ হিসেবে। ১৯৩৬ সাল থেকে একটানা তিন বছর জুনিয়র অ্যাথলেটিকসের বাংলা চ্যাম্পিয়ন তখনকার ইলা মিত্র ছিলেন এক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে ভারতীয় দলে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা আর অনুষ্ঠিত হয়নি। তিনি ১৯৪০ সালে বেথুন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ সালে বেথুন কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৪ সালে একই কলেজ থেকে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। এর চৌদ্দ বছর পর ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্রাবস্থায়ই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গে। পর্যায়ক্রমে তিনি যুক্ত হন গার্লস স্টোরস কমিটি, ছাত্র ফেডারেশন, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। মন্বন্তরের সময় তিনি একদিকে খাদ্য আন্দোলন ও ভুখা মিছিলে যোগদান করেছেন, লঙ্গরখানা পরিচালনায় সহায়তা করেছেন; অন্যদিকে খাদ্যাভাব, কাপড়ের সঙ্কট, মহামারী এবং নারী ব্যবসায়ীদের হাত থেকে অসহায় মেয়েদের বাঁচাতে তার সংগঠনের ভূমিকায় শরিক হয়েছেন।

বিবাহ সূত্রে ১৯৪৫ সালে তাকে চলে আসতে হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরে। সামন্ত পরিবারের রক্ষণশীলতাকে ভেঙে তখনকার পল্লির অচলায়তনকে অতিক্রম করতে তিনি যুক্ত হন মেয়েদের জন্য গড়া নতুন স্কুলের সঙ্গে, শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তী সময়ে পরিবারের শ্রেণি অবস্থানকে অতিক্রম করে কমিউনিস্ট নেতা ও স্বামী রমেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন জমিদারি উচ্ছেদ ও জোতদার শোষণের বিরুদ্ধে স্থানীয় পর্যায়ের আন্দোলনে। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নোয়াখালীর হাসনাবাদে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজেও অংশ নেন।

১৯৪৬-১৯৪৭ সালে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বাংলার ১৯টি জেলায় গড়ে ওঠে ‘তেভাগা’ আন্দোলন, তা পরিব্যপ্ত থাকে ১৯৪৯-১৯৫০ সাল পর্যন্ত। তেভাগার দাবিতে রাজশাহী জেলার বিশেষভাবে নাচোলের, কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ইলা মিত্র অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। আদিবাসী কৃষকদের মধ্যে তার এতটাই গ্রহণযোগ্যতা ছিল যে, তারা তাঁকে শুধু বিশ্বাসই করতেন না, সেই সঙ্গে নিজেদের একজন বলেও ভাবতেন। ইলা মিত্র ক্রমেই হয়ে ওঠেন সাঁওতাল ও অন্যান্য কৃষকের ‘রানি মা’। সাঁওতাল মেয়েদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার এবং সংগঠনে তাদের টেনে আনার ক্ষেত্রে ইলা মিত্র সবিশেষ দক্ষতার পরচয় দেন। বরেন্দ্র এলাকায় প্রচলিত ব্যবস্থায় বিশ আড়ি (কাঠা/ধামা) ধান কাটা ও মাড়ানোর জন্য জমিতে চাষাবাদ করেছেন যে কৃষক, তিনি মজুরি পেতেন তিন আড়ি ধান। ওই ধানের পরিমাণ বাড়িয়ে সাত আড়ি করা এবং ফসলের তিন ভাগ প্রতিষ্ঠার দাবিতে তার ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে, তা জায়গা করে নিয়েছে কালোত্তীর্ণ স্থানীয় লোকগীতিতে। একটি আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তুলতে যে ক্যারিশমাসম্পন্ন নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়, নাচোল বিদ্রোহে তিনি তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি যে জনমনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘তেভাগা’ আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নাচোল আয়োজিত সমাবেশে। তাকে একনজর দেখার জন্য ভিড় জমেছিল বিপুল জনতার।

তবে নাচোলের তেভাগা আন্দোলন শেষাবধি সফল হয়নি। কৃষকদের সঙ্গে সংঘর্ষে দারোগাসহ চারজন পুলিশ নিহত হওয়ার সূত্রে পাকিস্তানি শাসকরা আদিবাসীদের ওপর প্রচণ্ড নিপীড়ন চালাতে শুরু করলে নাচোলের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। ৫ জানুয়ারি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে সকাল ৯টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একটি গরুর গাড়িতে করে তিনজন কনস্টেবলসহ ‘ঘাসুরা’ গ্রামে উপস্থিত হন এবং জনৈক অক্ষয় পণ্ডিতের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পান তার বাড়ির আঙিনায় দুই কৃষক বাদান ও ফেলু ধান সরাচ্ছে। পুলিশ তৎক্ষণাৎ ওই দুজনকে গ্রেফতার করে এবং তাদেরসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে ঘাসুরা প্রাইমারি স্কুলে উপস্থিত হয়।

গ্রামে পুলিশের আগমন এবং কয়েকজন কৃষককে স্কুলে আটক করার সংবাদ আশপাশে ছড়িয়ে যায়। ফলে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে শত শত গ্রামবাসী বেরিয়ে আসে এবং পুলিশের কাছ থেকে আসামিদের কেড়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। ইলা মিত্র নিজে চরম লাঞ্ছনার শিকার হন। এ ছাড়া তাকে এক নম্বর আসামি করে অনিমেষ লাহিড়ী, বৃন্দাবন সাহা, শেখ আজাহার হোসেনসহ মোট ৩১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রুজু করা হয় এবং বিচারে ইলা মিত্রসহ ২৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে তার মুক্তির দাবিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ বিভিন্ন মহল সোচ্চার হয়। নাচোলে সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের বিষয়টি পূর্ব বাংলার সংসদে উত্থাপনের চেষ্টা মুসলিম লীগ সরকার প্রতিহত করে। তবে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় হীরেন মুখার্জি ইলা মিত্রের বিষয়টি জোরালোভাবে উত্থাপন করেন। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হলে চিকিৎসার প্রয়োজনে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে কলকাতা যাওয়ার পর ইলা মিত্র আর পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) ফিরে আসেননি।

ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিশ্চিত না হওয়ায় প্রচণ্ড দুরবস্থায় কয়েক বছর বস্তিতে জীবনযাপন করেন। এরপর এমএ পাস করে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৮ সময়কালে মানিকতলা নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি পর পর চারবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে দুবার তিনি ছিলেন বিধানসভায় কমিউনিস্ট পার্টির ডেপুটি লিডার।

ভারতে শিক্ষা আন্দোলন ও নারী আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালনকারী ইলা মিত্র ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক পর্যায়ের নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভারত সরকার তাকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ হিসেবে এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার অ্যাথলেটিকসে অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করে। ইলা মিত্র অনূদিত বইয়ের নাম : ‘এ গার্ল ফ্রম হিস্টোরি’, ‘হার্ট অ্যান্ড সোল’। ‘হিরোশিমার মেয়ে’ বইটির জন্য তিনি ‘সোভিয়েটল্যান্ড নেহরু’ পুরস্কার লাভ করেন। ইলা মিত্রের কাছে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ছিল তীর্থভূমি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশ ক’বার তিনি বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। ইলা মিত্র ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর কলকাতায় মারা যান।

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads