• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

‘জীবন’ -এর গল্প

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ০৫ অক্টোবর ২০১৯

‘জীবন’ সবুজ পাহাড়ে ঘেরা অপরূপ নৈসর্গিক লীলাভূমি রাঙামাটিতে গড়ে ওঠা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ২০১১ সালে রাঙামাটির সাজিদ-বিন-জাহিদ (মিকি) ও তার ৭ জন বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠা করে সংগঠনটি। পার্বত্যাঞ্চলে এটিই সর্বপ্রথম উদ্যোগ যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগিয়ে রক্তদানের মতো মহৎ কাজটিকে ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র। ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে পার্বত্যাঞ্চলের সর্বপ্রথম অনলাইন ব্লাড ব্যাংক ‘জীবন’।

শুরুতে মাত্র ৮ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা করা সংগঠনটি আজ ৩০০ নিবেদিত স্বেচ্ছাসেবীর বিশাল পরিবার। এই পরিবার তার আন্তরিকতা ও নিষ্ঠায় আপন করে নিচ্ছে এই জনপদের সর্বসাধারণকে। সংগঠনটি আজ পার্বত্যাঞ্চলে বিশ্বাসের অপর নাম।

সংগঠনের শুরু যখন সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক আনোয়ারুল কবিরের বাবার জন্য হঠাৎ রক্তের প্রয়োজন পড়ে। একজন অজ্ঞাত স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতার এই নীরব ভূমিকার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আজকের ‘জীবন’।

সংগঠনটির স্বপ্নদ্রষ্টা সাজিদ-বিন-জাহিদ (মিকি) ও তার ৭ বন্ধুকে ঘিরেই নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখেছে পার্বত্যাঞ্চলের হাজারো মুমূর্ষু রোগী।

জরুরি মুহূর্তে রক্তের প্রয়োজন হলেই রিং বেজে ওঠে। সংগঠনটি সপ্তাহের সাত দিনই ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে।

সংগঠনের কল সেন্টারের নাম্বার হলো ০১৮৫৪-২৬৬৬৭৪, ০১৩১২-১৫৪২৬৬।

এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রক্তদানের গুরুত্ব তুলে ধরতে ও প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে ‘হ্যালো ক্যাম্পাস’ অ্যাকটিভেশন কার্যক্রম পরিচালনা করছে সংগঠনটি। ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন কর্মদক্ষতামূলক ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ‘হ্যালো টিম’। এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৫০০ ছাত্রছাত্রী ও পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ‘হ্যালো ক্যাম্পাস’ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়েছে ‘জীবন’। সংগঠনটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী এবং অনলাইনভিত্তিক।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগিয়ে সংগঠনটি তাদের কাজ পরিচালনা করছে বিগত ৭টি বছর। রক্তদাতা ও রক্তগ্রহীতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করিয়ে দেয় সংগঠনটি। সম্পূর্ণ যাচাই বাছাই করে রক্তদাতাদের নিজ দায়িত্বে হাসপাতালে পৌঁছানো পর্যন্ত খবরাখবর নেয় একান্ত আপনজন হয়ে। সম্পূর্ণ নিবেদিতপ্রাণ একঝাঁক তরুণের সমন্বয়ে গঠিত টীমের সার্বিক তত্বাবধানে রক্তদাতা নিবন্ধন ও রক্তদান কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে ‘জীবন’।

রাঙামাটির বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে স্বতন্ত্র ইউনিট। ইউনিটগুলো নিজস্ব পরিকল্পনায় মানবতার সেবায় অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে।

অনলাইনে রক্তদান কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী সামাজিক সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে সংগঠনটি। কখনো ছুটে যাচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে খুব আপনজন হয়ে কখনো বা নিজের জীবন ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ধস বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুদের জীবন রক্ষায়।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও সবসময় সেবা প্রদান করে গেছে সবুজ টি-শার্ট গায়ে জড়ানো তরুণ এই স্বেচ্ছাসেবীরা।

নিজেদের পরিচিত করেছে গ্রিন আর্মি হিসেবে। পাহাড়ঘেরা অঞ্চলে পাহাড়সম দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে এই তরুণরা।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এরাই উদ্বুদ্ধ করছে এই জনপদের মানুষদের। জাগ্রত করছে মানবিক অনুভূতি। ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেলে’র মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে ‘জীবন’। রয়েছে নিজস্ব মেডিকেল সেল। পার্বত্যাঞ্চলে রক্তদান নিয়ে কাজ করে সর্বমহলে বেশ প্রশংসিত ও পরিচিত ‘জীবন’।

‘জীবন’-এর নারী সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি স্বতন্ত্র শাখা ‘অপরাজিতা’। ‘অপরাজিতা’ এই সংগঠনের একটি অন্যতম প্রশংসনীয় উদ্যোগ যা নারী স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন, নারী ও শিশু সহিংসতা প্রতিরোধের পাশাপাশি স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে। শিক্ষার্থীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে এবং স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ডিগনিটি বক্স’ বিতরণ ও মাসিকবান্ধব টয়লেট কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সংগঠনটি।

জীবনের প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক সাজিদ-বিন-জাহিদ বলেন, ‘আমরা জীবন-এর কাজ শুরুই করি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগিয়ে। আমরা লক্ষ্য করেছি, তারুণ্য নিজেদের বেশিরভাগ সময়ই ব্যয় করে এই যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে। আমরা এই অবসরের সঙ্গীকে আমাদের কাজের মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়েছি। আমরা যখন কাজটি শুরু করি ২০১১ সালে, তখনো পার্বত্যাঞ্চলে ইন্টারনেট তেমন বিস্তৃতি লাভ করেনি আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর সঙ্গে অনেকেই পরিচিত ছিল না। রাঙামাটির রোগীদের কাছে রক্তদানের মতো সহজ বিষয়টিও ছিল খুব আতঙ্কের। মূলত দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলগুলো থেকে রোগী এসে শহরে যোগাযোগের অভাবে রক্তদাতাদের খোঁজ পেতো না। আমরা এই তাগিদ থেকেই নিজেদের ডাটাবেজ সমৃদ্ধ করার কাজ শুরু করি। স্বেচ্ছায় রক্তদানকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে আমরা প্রতিনিয়ত নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা রক্তদাতা ও রক্ত গ্রহীতার মাঝে তৈরি করে দিচ্ছি সেতুবন্ধন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ভিন্নধর্মী আয়োজন। রক্তদানের পাশাপাশি সামাজিক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে ছাত্রছাত্রীদের সম্পৃক্ত করানোর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করে যাচ্ছি। নারী স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমাদের রয়েছে স্বতন্ত্র শাখা অপরাজিতা। আমাদের লক্ষ্য পুরো বাংলাদেশে শতভাগ রক্তদান নিশ্চিত করা স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের মাধ্যমে। রক্তদান ঐচ্ছিক বিষয় নয়, এটি দায়িত্বের চেয়ে বেশি কিছু। আমরা কাজ করে যাচ্ছি এবং আমাদের কাজে সবার সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা আশা করছি। ‘নির্ভর নয়, নির্ভার করার প্রত্যয়’ এই নীতিতে বিশ্বাসী আমরা।’

তরুণদের মাঝে সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরিতে বেশ উদ্যমী সংগঠন ‘জীবন’ তাদের কর্মের স্বীকৃতি পেল জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। সারা দেশের সেরা দশে নির্বাচিত হয়েছে এই সংগঠনটি।

তিন পার্বত্য জেলা থেকে একটি মাত্র সংগঠন ‘জীবন’ প্রতিনিধিত্ব করেছে পার্বত্যাঞ্চলকে এবং পেয়েছে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড।

২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর জীবনের প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক সাজিদ-বিন-জাহিদের হাতে সাভারের শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে ইয়াং বাংলা আয়োজিত ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ১৮’ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। পাহাড়ের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে ‘জীবন’ জীবনের জন্য। ভবিষ্যতে ‘জীবন’ রচনা করবে নতুন কোনো বিজয়ের গল্প- এটাই এখন প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads