• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

‘লেইস ফিতা লেইস’

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ২০২০

সংগীতগুরু জেমসের সেই গানের কথা মনে আছে কি? লেইস ফিতা লেইস, চুড়ি ফিতা, রঙিন সুতা রঙিন করিবে মন! লেইস ফিতা লেইস। নিঃশব্দে, কোলাহলে ঈমান আলী হেঁকে বেড়ায় লেইস ফিতা লেইস! পথে পথে সে বিক্রি করে বাক্সবন্দি কিছু সৌন্দর্যের স্বপ্নসুখ! সেই ঈমান আলীকে নিয়ে আমাদের ‘লেইস ফিতা লেইস’- এই কথাগুলো এই গানটির মিউজিক ভিডিওর শুরুতেই লেখা, নব্বইয়ের দশকে এত চমৎকার ভিডিও বানানো হয়েছিল যে ভাবতেই অবাক লাগে!

বাক্সবন্দি ব্যবসায়ী লেইস ফিতাওয়ালারা শুধু গ্রামে, মফস্বলেই জনপ্রিয় ছিলেন না, তারা জনপ্রিয় ছিলেন রাজধানী ঢাকাতেও। তাদের ব্যবসাও হতো বেশ। কিন্তু এখন আর সেই নব্বই দশকের সেই লেইস ফিতাওয়ালাদের আগের মতো দেখা মেলে না। শহরের যান্ত্রিকতার ভিড়ে হারিয়ে গেছে বাক্সবন্দি ব্যবসায়ী লেইস ফিতাওয়ালারা। তবে মফস্বল বা গ্রামের পথেও তাদের পদচারণা কদাচিৎ ঘটে। আধুনিক সভ্যতা কেড়ে নিয়েছে সেই লেইস ফিতাওয়ালাদের বিচরণ। তাই সচরাচর আর চোখে পড়ে না কাগজের কার্টনের ওপর সাদা বা লাল কাপড় পেঁচিয়ে পুঁটলি কাঁধে ঝুলিয়ে আরেক হাতে কাচের ঢাকনাওয়ালা বাক্স বহনকারী লেইস ফিতাওয়ালাদের।

সে সময় দুপুরের পর যখন অন্দরমহলের নারীরা মধ্যাহ্নভোজ সেরে উঠানের আড্ডার জন্য প্রস্তুত হতো, তখন রাস্তা দিয়ে হেঁকে যেতেন লেইস ফিতাওয়ালারা। তাদের সে ডাক শুনে খুকুমণিরা বায়না ধরত ফিতা-চুড়ি কিনবে। বাহারি রঙের নেইল পলিশ কিনবে।

নারী বরাবরই প্রসাধনপ্রিয়, খুকুমণিদের আবদারে খুকুমণির মায়েরও দেখতে ইচ্ছা করত কী আছে ফেরিওয়ালার বাক্সে! এটা থেকে ওটা পরখ করে নারীরা কিনে নিতেন স্নো, ক্রিম বা কদুর তেল। খুকুমণির কাঁধঝোলানো চুলে বেঁধে দেয়া হতো লাল টুকটুকে ফিতা। লেইস ফিতাওয়ালার এক বাড়ি থেকেই ব্যবসা হতো বেশ। তার পরিবার চলতো হেসেখেলে।

এখন বাক্সবন্দি ব্যবসার চেয়ে অনেকে দোকান খুলে কিংবা অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকে গেছেন অনেকটা। ফেরি করে লাভবান হওয়া যায় না বলে ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসা থেকে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তাই তাদের আর দেখা মেলে না। খুকুমনিরাও আজকাল আর লাল ফিতার বায়না ধরে না।  ধরবেই বা কীভাবে। এখনকার অনেক বাচ্চারা লেইস ফিতাওয়ালাদের চিনবেই না। কারণ এ ঐতিহ্য এখন যে বিলীন হওয়ার পথে! মানুষের এখন কিছু লাগলে মার্কেটে যায়। শুধু রাজধানীতে নয় বাংলাদেশের সব জায়গাতেই প্রচুর মার্কেট গড়ে উঠেছে। তাই নারী-শিশুদের কিছু লাগলে সবাই এখন মার্কেটেই যান। আবার অনলাইন মার্কেট থাকায় আরো সুবিধা  হয়েছে। অনেকে অনলাইনে প্রোডাক্ট দেখে অনলাইনে অর্ডার করেন। বাসায় সহজেই ডেলিভারি পেয়ে যান। ফলে নব্বই দশকের লেইস ফিতাওয়ালাও এখন ব্যবসা গুটিয়ে অন্য কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন।

ফরিদপুরের বোয়ালমারীর সাতৈরের ডোবরা এলাকার লেইস ফিতাওয়ালা খোরশেদ জানান, এখন আর আগের মতো গ্রামে কেউ চুড়ি-ফিতা কেনে না। মার্কেটে সবরকম প্রসাধনসামগ্রী আর সাজসজ্জার জিনিস পাওয়া যায়। এখন সবাই মার্কেটে যান। তারপরও খোরশেদের কণ্ঠে শোনা যায় ‘লেইস ফিতা, এই লেইস ফিতা’র ডাক। তাহলে খোরশেদের সংসার কীভাবে চলে? এমন প্রশ্নের জবাবে খোরশেদ বলেন, ‘আমার বংশ প্রথম থেকেই এই ব্যবসা করে আসছে। আমি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। তবে এখন ব্যবসার অবস্থা খারাপ। তাই সারাদিন এগুলো বিক্রি করার পর রাতে আবার চায়ের দোকানে বসি কিছু টাকা আয় হয়।’ জানা যায়, এখন আর গ্রামের মহিলারা আগের মতো লেইস ফিতাওয়ালাদের ডাকেন না। যুগের সঙ্গে খোরশেদরা এখন অবহেলিত।

শেরপুর জেলার গজনী এলাকার বাসিন্দা সাহানা বেগম। আগে চলতেন লেইস ফিতা বিক্রি করেই। এখন নিজেই স্থানীয় মার্কেটে লেইস-ফিতা-চুরির দোকান দিয়েছেন। সাহানা বলেন, ‘সময় বদলাইছে। এহন আর মানুষ বাইরে থেকে কিছু কিনতে চায় না। কাস্টমার মনে করে বাইরে থেকে জিনিস কিনলে সেটা ভেজাল হয়। মানের দিক থেকে  ভালো হয় না। তাই মহিলারা এখন মার্কেটে আসেন, দোকান থেকে কেনেন। তাদের ধারণা, দোকানেই মানসম্মত জিনিস পাওয়া যায়। তাই মার্কেটে দোকান দিয়েছি। ব্যবসা ভালোই।’

ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা সালেহা বেগম বলেন, ছোটবেলায় লেইস ফিতাওয়ালার কাছ থেকে জিনিস কিনতাম। এখন আর তাদের দেখা যায় না। সবাই একসঙ্গে এটা সেটা দেখে অনেক মজা করে চুড়ি-ফিতা, নেইল পলিশ কিনতাম। আগের দিনগুলো সত্যি অনেক মজার ছিল। এখন সবাই মার্কেটে যেয়েই সব কিনে।’

রাজধানীর সেনানিবাস এলাকার বাসিন্দা বিউটি আক্তার বলেন, ছোটবেলায় বিকেলে যখন ঘুমিয়ে পড়তাম ফেরিওয়ালার ‘লেইস ফিতা লেইস’ ডাক শুনে উঠে যেতাম। সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের কাছে বায়না ধরতাম লালফিতা কিনে দেওয়ার জন্য। সেই লালফিতা মাথায় বেণি করে পেঁচিয়ে চারদিকে ঘুরে বেড়াতাম। সেই দিনগুলো সত্যি অসাধারণ ছিল। দিন এভাবেই চলে যায়।

যুগের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় এরকম অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। হয়তো আরো কিছুদিন পর ‘লেইস ফিতা লেইস’ ফেরিওয়ালাদের কেউ চিনবে না। সময়ের পরিক্রমায় অনেকে অবাক হবে যে চুড়ি-ফিতা-লেইস ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা হতো। এসব এখন বলতে গেলে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। তারপরও খোরশেদরা বলেই চলেন, ‘লেইস ফিতা লেইস, চুড়ি-ফিতা, রঙিন সুতা রঙিন করিবে মন! লেইস ফিতা লেইস...।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads