• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

আনোয়ারা সৈয়দ হক গল্পের সুতোয় মনস্তত্ত্ব

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ০৭ নভেম্বর ২০২০

আনোয়ারা সৈয়দ হক শুধু একজন কথাসাহিত্যিকই নন, পাশাপাশি তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদকসহ আরো অনেক পুরস্কার।

আনোয়ারা সৈয়দ হক জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪০ সালের ৫ নভেম্বর। পিতা রফিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন ব্যবসায়ী। মা আছিয়া খাতুন গৃহিণী।

শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন তিনি যশোরে। সেখানে চুড়িপট্টির মোহনগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন মায়ের হাতে প্রথম পাঠ নিয়ে। মধুসূদন তারা প্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৮ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্কুল ও কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন।

বাবার আগ্রহে ১৯৫৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এই মেধাবী। ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাস করে বেরিয়েছিলেন মানবসেবার অঙ্গীকার নিয়ে। সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানবসেবার পাশাপাশি সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা নিয়ে এগিয়ে গেছেন।

৫ নভেম্বর ৮০ বছর পূর্ণ হলো তার। দীর্ঘদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আপন প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। পারিবারিক জীবনে তিনি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিণী ছিলেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে নিয়মিত লিখতেন তিনি।

আনোয়ারা সৈয়দ হকের পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ‘তৃষিতা’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৬ সালে। ১৯৬৮ সালে ‘সচিত্র সন্ধানী’ পাক্ষিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলো উপন্যাস ‘সেই প্রেম, সেই সময়’। কর্মজীবন ও সংসার যাপনের বাইরে বেরিয়ে নিজেকে নিমগ্ন করলেন শিল্প-সাহিত্য চর্চায়।

এ পর্যন্ত লিখেছেন ৩৩টি উপন্যাস। নারীদের নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী ‘ব্যবহূতা’ অলোচিত হয়।  এ ছাড়া নরক ও ফুলের কাহিনী, নারী : বিদ্রোহী, ঘুমন্ত খেলোয়াড়, খাদ, নিঃশব্দতার ভাঙচুর, উদয় মিনাকে চায়, অস্থিরতার কাল, ভালোবাসার সময় ইত্যাদি উপন্যাসে তার দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।

ছোটগল্প ‘হেলাল যাচ্ছিলো রেশমার সাথে দেখা করতে’- এরকম অনন্য কিছু গল্পসহ তার লেখা প্রায় ১১টি গল্প আছে।

তার শিশুতোষ রচনায় আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রসঙ্গ, ঘটনা ও কাহিনীর চমৎকার বয়ান। যে পাঠ থেকে আগামী প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহিত দেশপ্রেমের মন্দাকিনী। এ ছাড়া শিশুদের মনোভূমি বিনির্মাণে নীতিনৈতিকতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় ২৫টি রচনা রয়েছে তার। প্রবন্ধের ৭টি গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ্য, ক্ষুব্ধ সংলাপ, মেয়ে হয়েছি বেশ করেছি, পিকাসোর নারীরা, নারীর কিছু কথা।

কাব্যগ্রন্থেও তিনি নারীর মুক্তি খুঁজেছেন নিজের মতো করে। প্রথম নারী কাব্যগ্রন্থের নাম ‘কিছু কি পুড়ে যাচ্ছে কোথাও’।

অন্যদিকে মনোচিকিৎসক হিসেবে ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হকের রয়েছে আলাদা খ্যাতি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে একের পর এক ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘কাকে মানুষ বলব আর কাকে মানুষ বলব না, সেটা বুঝতে হবে। যদি ওই চেহারার ভেতরে মনুষ্যত্ববোধ না থাকে, যদি ওই চেহারার ভেতর পাশবিক প্রবৃত্তি থাকে, আচার-আচরণ, প্রবণতায় হিংস্র পশুত্বের প্রকাশ ঘটে তবে সে মানুষের সমাজে বসবাসের যোগ্য নয়। এখন কথা হচ্ছে, তারা মানুষের গর্ভে জন্ম নিয়ে কেন এমন পশুর প্রবৃত্তি নিয়ে বড় হলো? এর দায় পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ হয়ে রাষ্ট্র পর্যন্ত। অর্থাৎ সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর মা-বাবা তাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলি, চারিত্রিক বিবেকবোধ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। একইভাবে সমাজও তাকে মনুষ্যত্ববোধ সম্পর্কে সজাগ করতে পারেনি।’

আনোয়ারা সৈয়দ হক আরো বলেন, ‘সমাজ যখন এই মানুষরূপী অমানুষদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় কিংবা সুবিচার নিশ্চিত করতে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়, তখন এই অপরাধীরা আরো প্রলুব্ধ হয়। তাদের ভেতরকার পশুবৃত্তি আরো বেড়ে যায়। অপরাধকে তারা অপরাধ হিসেবে গণ্য করে না। উল্টো অপরাধকে তারা নিজেদের প্রেরণা হিসেবে দেখে।’

তিনি বলেন, ‘আইনি কাঠামো ও বিচারের সংস্কৃতি অপরাধীদের মনোজগতে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রলম্বিত হলে সমাজে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো বেড়ে যায়। কারণ একজন মানুষের মানসিক পরিস্থিতি অনেকাংশে নির্ভর করে তার পারিপার্শ্বিকতা, পরিবার, শিক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রের আচরণের ওপর। ফলে এ কথা বলা যায়, এ ধরনের পাশবিক অপরাধের দায় শুধু ওই অপরাধীর নয়, এর দায় সমাজ এবং রাষ্ট্রের ওপরও বর্তায়। কারণ মানুষরূপী ওই অপরাধীর মনের ভেতর সুন্দর মানবিক গুণাবলির জন্ম দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।’

এই মনোচিকিৎসক আরো বলেন, ‘শিক্ষা পেলেও অনেকের নৈতিকতার জায়গায় মানবিকতা জাগ্রত হয়নি, আবার অনেকে ধর্মীয় চর্চারত থেকেও দিব্যি পাশবিক আচরণ কিংবা অপরাধ করছে। এ থেকে বোঝা যায়, যে শিক্ষা এরা পেয়েছে তাতে গলদ রয়েছে। অর্থাৎ অপরাধীরা অপরাধ প্রবণতাকে নিবৃত্ত করতে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি।’

যোগ করে তিনি আরো বলেন, ‘এবার করোনাকালে আরো কিছু ব্যতিক্রমী বিষয় আমাদের সামনে এসে পড়েছি। বলা যায় মহামারীকালে ভয়ে কিছুদিন এসব কুপ্রবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ খারাপ কাজ থেকে দূরে ছিল। সেই ভয় কেটে যেতেই এই পাশবিক প্রবণতাগুলো আবার উসকে উঠেছে।’

ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘সামনে যেন এ ধরনের কোনো ঘটনা আমাদের আর দেখতে না হয় সে জন্য প্রয়োজন এসব পৈশাচিক অপরাধে জড়িতদের দ্রুত সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। তাহলে পশু প্রবৃত্তির মানুষদের মধ্যে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অপরাধীরা অপরাধ করতে ভয় পাবে, অপরাধের ইচ্ছা জাগলেও দমিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিবাচক আচরণে সামগ্রিক অপরাধপ্রবণতা থেকে নিজেদের দূরে রাখার সুযোগ পাবে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads