• বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪২৯

হবিগঞ্জের কিশোরী বিউটি আক্তার

ফাইল ফটো

প্রথম পৃষ্ঠা

বাবার সহায়তায় বিউটিকে কোপায় চাচা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৮ এপ্রিল ২০১৮

অবশেষে বেরিয়ে এসেছে হবিগঞ্জের আলোচিত কিশোরী বিউটি আক্তার হত্যার প্রকৃত রহস্য। হত্যাকাণ্ডে বিউটির বাবা সায়েদ আলী, চাচা ময়না মিয়া ও এক ভাড়াটে খুনি অংশ নেন। ভাই ময়না মিয়ার প্ররোচনায় সায়েদ আলী নিজেই বিউটিকে নানাবাড়ি থেকে মাঝরাতে ডেকে আনেন। শনিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় নিজ কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে এমন তথ্য জানান হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা।

পুলিশ সুপার আরো জানান, ডিসেম্বরে ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন নির্বাচনে ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার সংরক্ষিত মহিলা সদস্যপদে বাবুল মিয়ার মা কলম চান বিবির কাছে পরাজিত হন। এরপর থেকেই তাদের ঘায়েল করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন ময়না মিয়া। মূলত নির্বাচনের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

তিনি জানান, বিউটি ও বাবুল মিয়ার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তাই বিউটি পরিবারের কাউকে না জানিয়ে ২১ জানুয়ারি বাবুল মিয়ার সঙ্গে পালিয়ে যায়। তারা অলিপুর এলাকায় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে একটি বাসা ভাড়া নেয়। ৯ ফেব্রুয়ারি বিউটি প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি নিতে গেলে সেখানে কর্মরত তার মা হোসনে আরা জোর করে সুচীউড়া গ্রামের জালাল মিয়ার বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে একটি সালিশ-বৈঠক বসে বাবুল আর বিউটির বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাবুল বিয়ে করতে রাজি হয়নি। পরদিন বিউটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হবিগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিন দিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি আসে সে। আবারো এ নিয়ে সালিশ-বৈঠক বসে। কিন্তু সেখানেও বাবুলকে বিয়েতে রাজি করানো যায়নি। এর মধ্যে বিউটি আবারো অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে ৪ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী আদালতে একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলটি আমলে নিয়ে শায়েস্তাগঞ্জ থানাকে এফআইআর করার নির্দেশ দেন। শায়েস্তাগঞ্জ থানা মামলাটি এফআইআর করে মামলার বাদী ও ভিকটিমকে ১১ মার্চ থানায় আসতে বলা হয়। কিন্তু ১১ মার্চ বিউটি অসুস্থ থাকায় পরদিন তারা থানায় আসে। ১৩ মার্চ আদালত বিউটির জবানবন্দি গ্রহণ করে মা-বাবার জিম্মায় দেন। সেখান থেকে বিউটিকে নানার বাড়ি লাখাই উপজেলার গনিপুর গ্রামে পাঠিয়ে দেন বাবা-মা।

বিধান ত্রিপুরা আরো জানান, ৯ ফেব্রুয়ারি বিউটিকে উদ্ধারের পর তার বাবা তাকে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগেন। কিন্তু বাবুল মিয়ার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার জেরে কোনো জায়গায় বিয়ে দিতে পারছিলেন না। এ সুযোগে ময়না মিয়া সায়েদ আলীকে বোঝাতে থাকেন বিউটি বেঁচে থাকলে তার ছোট দুই মেয়েকে কখনো বিয়ে দেওয়া যাবে না। তাই বিউটিকে হত্যা করলে বাবুলকেও উচিত শিক্ষা দেওয়া যাবে এবং ছোট দুই মেয়েকে ভালো জায়গায় বিয়ে দেওয়া যাবে। সায়েদ আলী একসময় ময়না মিয়ার কথায় বিউটিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন।

পুলিশ সুপার জানান, ১৬ মার্চ রাত ১০টায় ব্রাহ্মণডোরা হাওরের বটগাছের নিচে বসে তারা হত্যার পরিকল্পনা করেন। সেই অনুযায়ী এক খুনিকে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া করা হয়। সেখান থেকে তারা গনিপুর গ্রামে যান। রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় ভাড়াটিয়া কিলারকে দূরে রেখে সায়েদ আলী ও ময়না মিয়া বিউটির নানার বাড়ি যান। এ সময় সায়েদ আলী সালিশ-বৈঠকের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে বিউটিকে যেতে হবে বলে নিয়ে আসেন। পথে হরিণাকোনা নামকস্থানে এলে বিউটিকে ভাড়াটিয়া খুনির হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় ময়না মিয়া তার হাতে থাকা ছুরি দিয়ে তাকে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ে বিউটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার মৃত্যু নিশ্চিত হলে তারা পাশের খাল থেকে পানি নিয়ে রক্তের দাগ মুছে ফেলে। পরে তারা লাশ খাদে নিয়ে বাহ্মণডোরা হাওয়ারে ফেলে রেখে চলে যায়।

বিধান ত্রিপুরা আরো জানান, শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের আদালতে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। দীর্ঘ সময়ের এ জবানবন্দিতে তিনি জানান, হত্যার আদ্যোপান্ত সম্পর্কে আদালতে বর্ণনা দেন।

এর আগে শুক্রবার বিকাল ৫টা থেকে তিন ঘণ্টাব্যাপী হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের আদালতে ময়না মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। জবানবন্দিতে ময়না মিয়া হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে বলে জানা গেছে। এদিকে এ ঘটনায় একই আদালতে গ্রেফতারকৃত আলোচিত বাবুল মিয়ার রাত ৮টা থেকে দুই ঘণ্টা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। সে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। এদিন নিহত বিউটির নানি ফাতেমা বেগম সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দেন।

অভিযোগ ওঠে, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের সায়েদ আলীর মেয়ে বিউটি আক্তারকে অপহরণের পর ২১ জানুয়ারি ধর্ষণ করে একই গ্রামের ইউপি মেম্বার কলম চান বিবির ছেলে বাবুল মিয়া ও তার সহযোগীরা। এক মাস পর বিউটি পালিয়ে এলে এ ঘটনায় ৪ মার্চ হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে বাবুল ও তার মা কলম চান বিবির (৪৫) বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন সায়েদ আলী। মামলায় সাক্ষী করা হয় সায়েদ আলীর ভাই ময়না মিয়াকে। এ ঘটনার পরই বিউটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লাখাই উপজেলার গনিপুর গ্রামে নানার বাড়িতে। ১৬ মার্চ রাতে সেখান থেকে নিখোঁজ হয় সে। পরদিন ১৭ মার্চ গনিপুর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে হাওরে তার মরদেহ পাওয়া যায়। মৃত বিউটির শরীরের একাধিক স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায় পুলিশ। এ ঘটনায় ১৮ মার্চ কিশোরীর বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে একই গ্রামের বাবুল মিয়া ও তার মা ইউপি সদস্য কলম চান বিবিকে আসামি করে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর অভিযান চালিয়ে কলম চান বিবিকে শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ এবং বাবুলের বন্ধু ইসমাইল মিয়াকে অলিপুর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৩০ মার্চ সিলেট থেকে গ্রেফতার করা হয় বাবুল মিয়াকেও।

অন্যদিকে বাবুলের মা ইউপি সদস্য কলম চান বিবিকে দুই দিনের রিমান্ড শেষে শুক্রবার রাতে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads