• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
খাদ্যের কথা ভাবলে পুষ্টির কথাও ভাবতে হবে

ছবি : সংগৃহীত

খাদ্য

জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ

খাদ্যের কথা ভাবলে পুষ্টির কথাও ভাবতে হবে

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২৫ এপ্রিল ২০১৯

আমরা বাঁচার জন্য খাই, তবে খাওয়ার জন্য বাঁচি না। বেঁচে থাকার জন্য খাবারের প্রয়োজন। তাই খাবার নিয়ে আমাদের ভাবনার শেষ নেই। গত দেড় দশকে খাবার নিয়ে আমাদের নতুন দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। দুশ্চিন্তার কারণ খাদ্যে ভেজাল। খাবারে ভেজাল আর বিষের ছড়াছড়ির কারণে মানুষের শরীরে অসুখ বাসা বাঁধছে। ভেজাল আর বিষাক্ত খাবার খেয়ে মানুষ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। আর এ কারণেই জনগণের মাঝে খাবার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। ভালো-মন্দ ভেবেচিন্তে খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত হচ্ছেন স্বাস্থ্যসচেতন নাগরিকেরা। এরই পাশাপাশি জনগণের মাঝে খাবারের পুষ্টিমান বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে যা ভবিষ্যৎ সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য আশাব্যঞ্জক। পুষ্টিবিদরা বলছেন, বিশেষত নারীদের মধ্যে ডায়েটের ব্যাপারে সচেতনতা বেড়েছে। আরো ভালো দিকটি হলো নারীরা এজন্য পুষ্টিবিদদের কাছে নিজের বা পরিবারের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের পরামর্শ পরামর্শ গ্রহণ করছেন। এরই সুবাদে দেশে পুষ্টিবিদদের চাহিদা বেড়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে একজন করে পুষ্টিবিদ থাকা আবশ্যক। লক্ষ করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক জীবনে স্থূলতা, ডায়াবেটিস কিংবা উচ্চ রক্তচাপের মতো যেসব সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তাকে মোকাবেলা করার জন্যই মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে ঝুঁকছেন।

 

একটি দেশ তো দাঁড়িয়ে থাকে তার সুস্থ-সচেতন জনগোষ্ঠীর ওপর। বাংলাদেশের মতো বিশাল জনসংখ্যার একটি দেশের জন্য ‘স্বাস্থ্য’ কিংবা ‘পুষ্টি’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। স্বাস্থ্য বা পুষ্টি সেই সুস্থ-স্বাভাবিক জনগোষ্ঠী তৈরিতে ভূমিকা রাখে। হতাশাজনক খবর হচ্ছে, দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে পরিমাণ শাক-সবজি ও ফল খাচ্ছি তা চাহিদার তুলনায় খুব কম। দেশে একজন পূর্ণবয়স্ক লোক গড়ে প্রতিদিন ৩০ গ্রাম শাক-সবজি ও ৪০ গ্রাম ফল খায়। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, খাদ্যকে পুষ্টির দিক থেকে সুষম করতে হলে প্রতিদিন একটি শিশুর জন্য কমপক্ষে ১০০ গ্রাম ও একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক ২০০ গ্রাম শাক-সবজি এবং ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। শাক-সবজি ও ফলমূলের পারিবারিক চাহিদা মেটাতে খুব একটা বেশি জমির প্রয়োজন হয় না। আমাদের বাড়ির আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা জমিগুলো পরিকল্পিতভাবে পুষ্টিসমৃদ্ধ শাক-সবজি ও ফল চাষের আওতায় আনা হলে তা থেকে সারা বছর পরিবারের সবার চাহিদা পূরণের মাধ্যমে অপুষ্টিজনিত রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আবার পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক মোট খাদ্যশক্তি চাহিদা ২৪৩০ কিলোক্যালরি। এর মধ্যে কমপক্ষে ফল থেকে আসা উচিত ২.৫%। কিন্তু আমরা গড়ে ফল থেকে পাচ্ছি মাত্র ১%। অথচ আমাদের দেশ ফলে সমৃদ্ধ দেশ। সারা বছর কোনো না কোনো দেশীয় ফলের ফলন হয়। দেশে এখন বিদেশি ফলেরও বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। তারপরও ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের এই পিছিয়ে থাকার কারণ খুঁজে বের করা দরকার। পাশাপাশি ফল খাওয়ার প্রবণতা বাড়ানো দরকার।

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে উন্নত করার পাশাপাশি নাগরিকদের সুস্বাস্থ্যের বিষয়ে নজর দিতে বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে পেটে ক্ষুধা নিয়ে এখন মানুষকে ঘুমাতে না হলেও সঠিক পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে দেশের অসংখ্য মানুষ। হারভেস্টপ্লাস আয়োজিত ‘ইমপ্রুভিং নিউট্রিশন থ্রু বায়োফরটিফাইড ক্রপ’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা বলেন, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪১ শতাংশ শিশু এখনো পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বিভিন্ন বয়সী ৭৩ শতাংশ নারীর রয়েছে জিঙ্ক স্বল্পতা। পাঁচ বছর বয়সী তিনটি শিশুর মধ্যে একটি খর্বাকৃতির। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যমতে, দেশের শতকরা ৭০ ভাগ পুরুষ এবং ৭৫ ভাগ মহিলা আয়রন স্বল্পতায় ভুগছে। ভিটামিন ‘এ’র ঘাটতি ৮৮% পরিবারে এবং ভিটামিন ‘সি’র ঘাটতি ৯০% পরিবারে বিদ্যমান। আবার ন্যূনতম খাদ্যশক্তির চেয়ে কম পরিমাণে গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার ১৯.৫%। খর্বকায় শিশুর হার ৩৬% এবং কৃশকায় শিশুর হারও ১৪%। আমরা জানি, ধারাবাহিকভাবে তীব্র অপুষ্টির শিকার হলে বয়সের তুলনায় শিশুরা খর্বকায় হয়। এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে আমরা বলতে পারি, সার্বিকভাবে উচ্চমাত্রার অপুষ্টির ঝুঁকিতে এখন বাংলাদেশ। তাই পুষ্টি নিরাপত্তাকে শুধু স্বাস্থ্যগত ইস্যু হিসেবে বিবেচনা না করে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়াটাই এখন জরুরি।

 

চাহিদা পূরণ করবে স্থানীয় ফল-সবজি

দেশে যথেষ্ট পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি ও ফলমূলের সরবরাহ রয়েছে। যার দ্বারা সব ধরনের পুষ্টি উপাদান মেটানো সম্ভব। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাক-সবিজ বা ডিম, ফলমূল ইত্যাদি থেকেই শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া সম্ভব। এ জন্য বাইরে থেকে খাবার আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। ভারতে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে জনগণের মাঝে। আমাদের দেশেও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালানো দরকার। ‘লোকাল ফুড সিস্টেম পুষ্টি চাহিদা পূরণে যথেষ্ট’- জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনিসেফও এ ধরনের ক্যাম্পেইনকে সমর্থন জানাচ্ছে। দেশে এমন কোনো জেলা নেই যেখানে কিছু না কিছু ফল বা শাক উৎপাদিত হচ্ছে না। ডিম এখন সর্বত্রই সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ছয় ঋতুতে শতাধিক রকমের ফল জন্মে। এসব ফল অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু। ফল ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অন্যতম উৎস। এটা রান্না ছাড়া সরাসরি খাওয়া যায় বিধায় বিদ্যমান পুষ্টিমান সবটুকুই দেহ গ্রহণ করতে পারে। এসব উপাদান মানবদেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশে মাথাপিছু দৈনিক ফলের প্রাপ্যতা মাত্র ৩৫ গ্রাম যা পুষ্টিবিজ্ঞানীদের সুপারিশকৃত ন্যূনতম চাহিদার এক-তৃতীয়াংশেরও কম। তাই দেশের জনগণকে দেশি ফল বেশি খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী করতে হবে। উচ্চ পুষ্টিসম্পন্ন বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত এবং অপ্রচলিত ফলের উন্নত জাত চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে সুষম খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা যায়। তবে কেবল উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও মানুষ খাদ্য ও পুষ্টিহীনতার শিকার হয়। তার বড় কারণ ক্রয়ক্ষমতার অভাব। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন শিক্ষার সঙ্গে কৃষির শিল্পায়ন।

 

প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করছে পোল্ট্রি শিল্প

বাংলাদেশের আমিষ ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে দিন দিন বেড়ে চলেছে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান। বাংলাদেশের মোট খাদ্য সরবরাহের ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ মাংস ও ডিম আসে পোল্ট্রি খাত থেকে। মোট প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৪০-৪৫ ভাগই জোগান দেয় এই শিল্পটি। আশার দিকটি হলো, মানুষের মাঝে এখন স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। মানুষ এখন লাল মাংসের পরিবর্তে সাদা মাংস খায়। আধুনিক বিশ্বে এখন পোল্ট্রি সহজলভ্য ও সুলভ আমিষের জোগানদাতা হিসেবে সব ধর্ম, বয়স ও পেশার মানুষের কাছে অগ্রগণ্য। সঙ্গত কারণেই পুষ্টি সমৃদ্ধিতে পোল্ট্রির গুরুত্ব বাড়ছে আমাদের দেশেও।

 

খেতে হবে সুষম খাবার

পুষ্টি নিরাপত্তা বলতে পরিবারের সবার জন্য সুষম খাদ্য হিসেবে পর্যাপ্ত আমিষ, ভিটামিন, খনিজ উপাদান এবং নিরাপদ পানীয় সরবরাহকে বোঝায়। যে খাদ্যে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সবকটি উপাদান পরিমাণমতো থাকে, তাকে সুষম খাদ্য বলা হয়। খাদ্যের মধ্যে এসব পুষ্টি উপাদান সঠিক পরিমাণে না থাকলে মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে এবং বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ ব্যাহত হয়। খাদ্যের কয়েকটি উপাদান যেমন- শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করাই হলো সুষম খাবার। শর্করা শরীরে শক্তি ও কার্যক্ষমতা জোগায়। চাল, গম, যব, আলু, মিষ্টিআলু, কচু, চিনি, মধু, গুড় ইত্যাদিতে প্রচুর শর্করা পাওয়া যায়। প্রতিগ্রাম শর্করা থেকে ৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। প্রোটিন হলো দেহ গঠন ও ক্ষয় পূরণকারী খাদ্য। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন ডাল, বরবটি, শিম, মটরশুঁটি ইত্যাদি দেহ গঠনে সহায়তা করে। প্রতি গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। চর্বি বা ফ্যাট দেহের কর্মদক্ষতা বজায় রাখে এবং ত্বক সুন্দর ও মসৃণ রাখে। সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, তিলের তেল, ঘি, মাখন, চর্বিযুক্ত মাছ, মাংস, ডিম ও কলিজা ইত্যাদি চর্বিযুক্ত খাদ্য। প্রতি গ্রাম চর্বি থেকে ৯ কিলো-ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। পানি শরীরকে পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা করে এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়া বিভিন্ন ফলের রস, পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করা দরকার। আঁশ দেহের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ওজন নিয়ন্ত্রণ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, অন্ত্রনালির সুস্থতা বজায় রাখে। খাদ্যের আঁশ উদ্ভিজ্জ খাদ্য থেকে পাওয়া যায়, যেমন- লালা আটা, যব, ভুট্টা, যবের ছাতু, শিম, শিমের বিচি, ডাল ও ডালজাত খাদ্য, খোসাসহ ফল, যেমন- কালোজাম, আঙুর, পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি ও সব ধরনের শাক-সবজি। খনিজ লবণ যেমন ফসফরাস, লৌহ, আয়োডিন, জিংক যা দেহ গঠন, ক্ষয় পূরণ, পরিপোষণ, দেহের শারীরবৃত্তীয় কাজ করে। আয়োডিন গলগণ্ড রোগ প্রতিরোধ করে। লৌহ রক্তস্বল্পতা দূর করে; হাত ও দাঁতের গঠন মজবুত করে। জিংক মানসিক বৃদ্ধি ও হাড়ের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ভিটামিন এ, ডি, ই, কে, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, সি- সব ধরনের সবুজ ও রঙিন শাক-সবজি, ফল, টকজাতীয় ফল, ডিম, দুধ, কলিজা, ছোট মাছ, লেবু চা ইত্যাদি খাদ্যে ভরপুর এবং রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্য। ভিটামিন ‘এ’ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘ডি’ রিকেট রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স ত্বকের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে। ভিটামিন ‘সি’ স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে।

 

যে পুষ্টিগুলো শরীরের জন্য দরকারি

স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথ ডাইজেস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খেতে হলে পুষ্টির বিষয়টি মাথায় রাখতেই হয়। এমন ১০ ধরনের পুষ্টি রয়েছে, যেগুলো সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এগুলোর অভাবে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।

আঁশ : একজন সুস্থ এবং প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ২১ থেকে ২৫ গ্রাম আঁশজাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন। এটি শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, শরীরে শক্তি জোগায়। এটি পেট ফোলা ভাব, গ্যাস ইত্যাদির সমস্যা প্রতিরোধ করে। শাক-সবজিতে আঁশ পাওয়া যায়।

পটাশিয়াম : সার্বিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য মাংসপেশি ও হূদযন্ত্রের যথাযথ কার্যকর থাকা প্রয়োজন। আর তাই শরীরে প্রয়োজন সঠিক মাত্রার পটাশিয়াম। কিন্তু ইউএসডিএ (দ্য ইউনাইটেড স্টেটস্ ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার)-এর মতে, ২০-২৯ বছর বয়সী অধিকাংশ নারীই সঠিক চাহিদার চাইতে কম পরিমাণে পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খান। দুই কাপ পরিমাণ ফলমূল (একটি আপেল, একটি কলা, টক দই ও স্ট্রবেরি) এবং আড়াই কাপ পরিমাণ সবজি (যে কোনো শাক-সবজি, সঙ্গে ব্রোকলি থাকলে ভালো হয়) খেলে শরীরে প্রতিদিনের পটাশিয়ামের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

ক্যালসিয়াম : প্রতিদিন এক হাজার মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খাওয়া প্রয়োজন। দুধ, দই, মটরশুঁটি, সবুজ শাক-সবজি ইত্যাদিতে ক্যালসিয়াম রয়েছে। ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁতকে সুরক্ষিত রাখে; পেশির গঠনে সাহায্য করে।

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড : ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আপনার শরীরে সেরেটোনিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করবে। সেরেটোনিন হলো মস্তিষ্কে ভালো লাগার অনুভূতিটি কাজ করানোর এক রাসায়নিক পদার্থ। যেহেতু এই সময়টায় মেয়েদের মধ্যে হতাশাগ্রস্ত থাকার প্রবণতা বেশি লক্ষণীয়, তাই তাদের শরীরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের সঠিক চাহিদা পূরণ করা বেশ প্রয়োজন। স্যামন ও টুনা মাছ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের সবচাইতে ভালো উৎস। এছাড়া আখরোট ও বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ থেকেও এর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

ম্যাগনেসিয়াম : ১৯ থেকে ৩০ বছর বয়সের নারীদের ৩১০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম খাওয়া জরুরি। ত্রিশের বেশি বয়সের নারীদের ৩২০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণ করতে হয়।

আয়রন : পেস স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের মতে, যেসব তরুণী ও নারীর শরীরে মিনারেলের অভাব রয়েছে এবং শরীরে আয়রনের মাত্রা কম, তারা বুদ্ধি-বিবেচনামূলক প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় বেশি নেয় এবং বুদ্ধিদীপ্ততা নেই বললেই চলে। শরীরে আয়রনের চাহিদা পূরণে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ১৮ মিলিগ্রাম আয়রন সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- চর্বিহীন গরুর মাংস, সয়াবিন, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, চামড়া ছাড়া মুরগির মাংস, ব্রোকলি, ডিমের কুসুম, শুকনো ফলমূল, গাঢ় সবুজ রঙের শাক-সবজি, বিভিন্ন ধরনের ডাল ও শস্য জাতীয় খাবার খেতে পারেন।

ভিটামিন-ই : প্রতিদিন ১৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন-ই গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভিটামিন-ই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের চাবি। এটি ক্ষতিকর ফ্রি রে‍ডিক্যাল থেকে শরীরকে সুরক্ষা দেয়। ফ্রি ‍রেডিক্যাল কোষকে নষ্ট করে দেয়। পালংশাক, কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম ইত্যাদিতে ভিটামিন-ই রয়েছে।

ভিটামিন-সি : প্রতিদিন ৭৫ গ্রাম ভিটামিন-সি শরীরে প্রয়োজন। কমলা, মাল্টা, ব্রোকলি, জলপাই ইত্যাদির মধ্যে ভিটামিন-সি রয়েছে। ভিটামিন-সিও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভালো উৎস। এটি ত্বককে ভালো রাখে; শরীর পুনর্গঠনে সাহায্য করে।

প্রোটিন : পিটস্‌বার্গ মেডিকেল সেন্টারের স্পোর্টস মেডিসিন বিভাগের পরিচালক লেসলি বনকি বলেন, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে কম করে হলেও ৬০-৭০ গ্রাম পরিমাণ প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন। প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য তিনি চামড়া ছাড়া মুরগির মাংস, মাছ, ডিম, মটরশুঁটি ও লো-ফ্যাট দুগ্ধ জাতীয় খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। মাংস, ডাল, দইয়ের মধ্যে প্রোটিন থাকে। পেশির গঠনে এবং শরীরে শক্তি জোগাতে প্রোটিনের প্রয়োজন রয়েছে।

আয়রন : প্রতিদিন ১৮ গ্রাম আয়রন শরীরে প্রয়োজন। কাঁচা কলা, কলিজা, কচুর লতি, ডালিম ইত্যাদিতে আয়রন রয়েছে। আয়রন শরীরে অক্সিজেন পরিবহনে সাহায্য করে। যাদের শরীরে আয়রনের ঘাটতি রয়েছে, তাদের রক্তশূন্যতা ও অবসন্নতার সমস্যা হয়।

ভিটামিন-ডি : প্রতিদিন একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ৬০০ আইইউ ভিটামিন-ডি গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভিটামিন-ডি পাওয়া যায় সূর্যের আলোতে। এ ছাড়া টুনা, স্যামন, ম্যাকরেল ইত্যাদি মাছে ভিটামিন-ডি পাওয়া যায়। ভিটামিন-ডি শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে। পেশির গঠন ও হাড় ভালো রাখতে কাজ করে।

ভিটামিন-এ : প্রতিদিন ৭০০ আইসিইউ ভিটামিন-এ গ্রহণ করতে হয়। গাজর, লালশাক, আলু ইত্যাদিতে ভিটামিন-এ রয়েছে। এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট স্বাস্থ্যকর টিস্যু গঠনে ও কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে। দৃষ্টি ভালো রাখতে কাজ করে।

পটাশিয়াম : প্রতিদিন ৪ দশমিক ৭ গ্রাম পটাশিয়াম শরীরের জন্য জরুরি। কলা, আলু ইত্যাদিতে প্রচুর পটাশিয়াম পাওয়া যায়। এটি কার্বোহাইড্রেটকে ভাঙতে সাহায্য করে এবং হূদস্পন্দন ভালো রাখে।

 

নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চিতে করণীয়

নিরাপদ পুষ্টির স্বার্থে ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত ও ভেজালমুক্ত খাবারে জোর দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সূত্রে জানা যায়, পুষ্টির উন্নয়নে এবং পুষ্টিকর নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে বহুমুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগির দেশের সব হাসপাতাল, বাস স্টেশন, লঞ্চ স্টেশন, রেল স্টেশন, অফিস-আদালতে বেস্ট ফিডিং কর্নার আরো কার্যকর করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে :

১. জৈব উপকরণের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ না করে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহী করতে হবে।

২. পারিবারিক এবং বাণিজ্যিকভাবে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি পালন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে গোবর-বিষ্ঠা উৎপাদন ও ফসলের জমিতে ব্যবহার করে রাসায়নিক সারের ওপর চাপ কমাতে হবে।

৩. প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে সাধারণ/ভার্মি-ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন ও জমিতে ব্যবহার করতে হবে।

৪. জৈব বালাইনাশক তৈরি ও ব্যবহারের জন্য কৃষকদের আগ্রহী করতে হবে।

৫. বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষকদের আইপিএম প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ এবং কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

৬. ফসল উৎপাদনের সময় এবং সংগ্রহোত্তর ধাপ, যেমন- প্যাকেজিং, সংরক্ষণ, পরিবহন, বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাত করা খাদ্য তৈরিসহ প্রতিটি পর্যায়ে ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিষমুক্ত করতে হবে।

৭. খাদ্যের ভেজাল নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট বসাতে হবে।

৮. ভেজাল প্রদানকারী অপরাধীকে প্রচলিত আইনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

৯. খাদ্যের কেমিক্যাল শনাক্তকরণ মেশিন স্বল্প মূল্যে বাজারজাত, মেশিন ক্রয়ে ভ্যাট প্রত্যাহার ও ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

১০. ফরমালিন আমদানি ও বাজারজাত করার ক্ষেত্রে প্রণীত আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

১১. খুচরা বাজারে ফরমালিন বেচা-কেনা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে।


লোকাল ফুড বলতে আমরা বোঝাচ্ছি- আমার বাড়ির আঙিনায় যেটা পাওয়া যাচ্ছে কিংবা বাড়ির পাশের বাজারে যেগুলো সবসময় পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো। নিজের বাড়ির আঙিনায় কুমড়া, লালশাক বা পুঁইশাকও তো আমরা লাগাতে পারি। যেখানে যা পুষ্টিকর খাবার স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়, সেটা যদি আমরা ভারসাম্য রেখে খাই; সঠিক পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিনস বা শাক-সবিজ খেতে পারি, তা হলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়।

ড. ইয়াসমিন বলেন, বাংলাদেশে আরেকটি জিনিস ছিল- আপনি কি শাক-সবিজ ধুয়ে কাটেন, নাকি কাটার পর ধোন? কাটার পর ধুলে কিন্তু তার ভিটামিন বা মিনারেলস চলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে সেই অভ্যাসটি পাল্টানোর জন্য জাতীয় স্তরে একটা ক্যাম্পেইন দরকার ছিল। আসলে সাধারণ মানুষ তাদের খাদ্যাভ্যাসে ছোট ছোট কিছু পরিবর্তন আনলেই নিজেদের ডায়েটে অনেক বেশি পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারবে।

— ড. ইয়াসমিন আলি হক, একজন বাংলাদেশি নাগরিক, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্রী, ভারতে ইউনিসেফের প্রধান

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads