• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
বিষাক্ত পানি ব্যবহার করছেন ঢাকাবাসী

বিষাক্ত পানি ব্যবহার করছেন ঢাকাবাসী

ছবি : বাংলাদেশের খবর

মহানগর

জলজ উদ্ভিদ বাঁচে না চার নদীতে

বিষাক্ত পানি ব্যবহার করছেন ঢাকাবাসী

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৯ মার্চ ২০১৯

পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু প্রতিদিন মানুষ যে পানি ব্যবহার করছেন তা কতটুকু নিরাপদ। কতভাগ মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার করছেন। ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে নদীগুলোর দূষিত হয়ে পড়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে নিরাপদ পানির উৎসগুলোতে দূষণ বেড়ে যাওয়া, ভূগর্ভস্থরের পানিতে আর্সেনিক ও লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়া। আবার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবের কারণে নিরাপদ পানির প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার বড় কারণ মনে করছেন তারা।

শহর এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করা পানি সঠিক নিয়ম না মেনে উৎপাদন করা হয়। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ছাড়পত্র ছাড়াই পানি উৎপাদন ও বিপণন করছে। এসব পানিতে নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়াসহ জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। আবার মানহীন রেস্তরাঁগুলোর সরবরাহ করা পানিতে কলিফর্ম নামের জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

এসব মানহীন পানি ব্যবহার না করতে বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকেও সতর্ক বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছেন, দেশের শতকরা ৮৭ ভাগ মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার করছেন। দেশের ১৩ কোটি ৯২ লাখ মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা ভোগ করছেন। দেশের মানুষের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সরকার ইতোমধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, খাদ্যের মান নিয়ে ঢালাওভাবে অভিযোগ ঠিক নয়। যেসব ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে সেগুলো খতিয়ে দেখে প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, দেশের মানুষ যে পানি ব্যবহার করছেন তার ১৩ শতাংশ আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। আর্সেনিক দূষণের কারণে নিরাপদ পানি ব্যবহারের উৎস সীমিত হয়ে পড়ছে। দেশে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলার টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক দূষণ পাওয়া যাচ্ছে। আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার না করার জন্য অনেক আগে থেকে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

বর্তমানে রাজধানীবাসীর পানির বড় উৎস ঢাকার চার নদী। এই নদীগুলোর পানি প্লান্টে পরিশোধন করে ঢাকাবাসীর জন্য সরবরাহ করছে ঢাকা ওয়াসা। অথচ এই চার নদীর পানি এত দূষিত যে ওয়াসার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে চার নদীর পানি এত পরিমাণ দূষিত হয়ে পড়ে যে সেই পানি ব্যবহার দূরে থাক, জলজ উদ্ভিদ পর্যন্ত এই পানিতে বাঁচে না। এসব নদীর কিনার  ঘেঁষে হেঁটে যাওয়াও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অথচ ব্যবহারের জন্য এই পানিই ওয়াসা পরিশোধন করে সরবরাহ করছে।

পানির নিরাপদ উৎসের বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে ভূগর্ভস্থরের পানিতে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে নদীর পানি প্রবাহ শুষ্ক মৌসুম একেবারেই কমে যাচ্ছে। এই মৌসুমে তিস্তাসহ অনেক নদীতে পানি প্রবাহ থাকছে না। ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ভূগর্ভস্থরের পানিতে মিশে যাচ্ছে।

পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কারণে দেশের পানির অনেক উৎস অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। এসব উৎস থেকে সরাসরি পানি ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবহূত এসব পানিতে নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়াসহ জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতেও দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। জারের ব্যবহূত পানির মান নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, দেশের পানীয় জলের নিরাপদ উৎসগুলোতে ব্যাকটেরিয়া ও আর্সেনিকের ভয়ঙ্কর মাত্রায় উপস্থিতি রয়েছে। দেশের প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ অপরিচ্ছন্ন এবং অনিরাপদ উৎসের পানি পান করছে। পানির নিরাপদ উৎসগুলোর ৪১ শতাংশই ক্ষতিকারক ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াযুক্ত। পাইপের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা পানিতে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৮২ শতাংশ।

৩৮ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতেও পাওয়া গেছে এই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া। পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়।

ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানিকে পুরোপুরি সুপেয় পানি বলা যাবে না। পানি দুর্গন্ধমুক্ত করতে যে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তা নিয়েও আরেক সমস্যা। পরিমাণে বেশি ব্যবহার করলে পানিতে কেমিক্যালের গন্ধ থাকে। আর পরিমাণে কম দিলে পানিতে দুর্গন্ধ থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার বিষাক্ত হয়ে পড়া পানি শোধন করতে মেশানো হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ক্লোরিন, লাইম (চুন) ও অ্যালাম (ফিটকিরি)। ফলে শোধনের পর অনেক সময় পানিতে ক্লোরিনের গন্ধ পাওয়া যায়। পুরনো পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করায় পানিতে অনেক সময় দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। কিছু এলাকায় পাইপলাইনে ফুটা করে অবৈধভাবে পানির লাইন দেওয়া হয়েছে। সেসব ফুটা দিয়ে ময়লা-আবর্জনা প্রবেশ করে পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ফোটানোর পরও সেই পানি দূষণমুক্ত করা যাচ্ছে না।

ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে বাসাবাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের সংযোগে ছিদ্র থাকায় পানির সংযোগ মিশে যায়। এতে দূষণ হতে পারে। আবার অনেক সময় বাসাবাড়িতে পানি বিশুদ্ধ না করায় দূষিত উপাদানও পাওয়া যেতে পারে। তবে ওয়াসা শোধনাগার বা উৎস থেকে বাসাবাড়িতে সরবরাহ পর্যন্ত পানির সংযোগ নিরাপদ করতে ওয়াসা কাজ করছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) একদল গবেষক বলছেন, রাজধানীতে সরবরাহ করা জারের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু ‘কলিফর্ম’ রয়েছে। জারভর্তি এসব পানি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। গবেষকদের মতে, পানিতে টোটাল কলিফর্ম ও ফেকাল কলিফর্মের পরিমাণ শূন্য থাকার কথা, বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন পানিতে দুটো জীবাণুর উপস্থিতি রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনগণ অসচেতনভাবে অনিরাপদ পানি ব্যবহার করছেন। একটু সচেতন হলেই পানি নিরাপদ করে ব্যবহার করা সম্ভব। তারা বলেন, বস্তি এলাকাসহ অনেক মানুষের অভ্যাস আছে পাইপলাইনের পানি সরাসরি ব্যবহার করার। কিন্তু এভাবে পানির ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পানির সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবহারের উপায় হলো পানি ভালোভাবে ফুটিয়ে পান করা।

নিরাপদ পানির ক্ষেত্রে গত বিশ বছর ধরে দেশে সবচেয়ে বড় যে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো আর্সেনিকের উপস্থিতি। আর্সেনিক নামক একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আবির্ভূত হয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায উঠে এসেছে, হিমালয় থেকে যেসব নদীর উৎপত্তি হয়েছে সেসব নদীই আসলে আর্সেনিকের প্রকৃত উৎস। হিমালয়ের নির্দিষ্ট প্রস্তরস্তরে সঞ্চিত আর্সেনিক বিভিন্ন নদীবাহিত দেশের বিশাল অংশের ভূস্তরকে গ্রাস করছে। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে হিমালয় থেকে বেরোনো সব নদীতেই আর্সেনিক রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়া চীন-তিব্বত-মিয়ানমার পর্যন্ত এটি বিস্তৃত। গবেষকদের মতে, নিম্ন গঙ্গা অববাহিকার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের ঘনত্ব এ কারণেই সর্বাধিক।

২০০১ সালে ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে বাংলাদেশের ৬১ জেলার নলকূপের পানি পরীক্ষা করে জানায় ৪২ শতাংশ নলকূপের পানিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের চেয়ে বেশি এবং ২৫ শতাংশ নলকূপের পানিতে বাংলাদেশের মানের চেয়ে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ জেলাতেই এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার এক রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা শহরের পানির স্তর এখন সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে ১৭০ ফুট নিচে নেমে গেছে। রাজশাহীতেও পানির স্তর ১৮ থেকে ২৯ ফুট নিচে চলে গেছে। ফলে সাগরের লোনা পানি দক্ষিণাঞ্চল পার হয়ে এখন ঢাকা মহানগরীসহ দেশের মধ্যাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের দিকে আসছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, ইতোমধ্যেই দক্ষিণাঞ্চলের ৬ কোটি মানুষ ভূগর্ভস্থ লবণাক্ততা বৃদ্ধিজনিত বিপর্যয়ের হুমকিতে রয়েছে। বাপা নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই পরিস্থিতি বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশের ক্ষেত্রে আরো সঙ্কটজনক পর্যায়ে উপনীত হতে পারে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads