সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম : রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি’ বইয়ে বলেছেন, একটি স্যুটকেস নিয়ে আমি দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছি। আমাকে বল প্রয়োগে দেশ ছাড়তে হবে এবং রাষ্ট্রহীন অবস্থায় বিদেশে থাকতে হবে- এটা কল্পনাও করিনি। কোনো টাকা না নিয়েই আমাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। আমার বাড়ি বিক্রির পুরো টাকাই অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য বিনিয়োগ করেছিলাম। যদি আমার অসৎ উদ্দেশ্য থাকত, তাহলে আমি আগেই এই টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারতাম। আমার আয়কর রিটার্ন সেটাই প্রমাণ করবে।
বইয়ের একটি অংশে তিনি বলেন, একজন প্রধান বিচারপতি যখন দায়িত্বে বা অবসরে যান, তার সঙ্গে সততা, মর্যাদা এবং দেশপ্রেম থাকে। তা না হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হবে। আমি রাষ্ট্রহীন হয়ে থাকতে চাই না। কিন্তু মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো- যদি আমি দেশে ফিরে যাই, তাহলে আমার জীবন কতটুকু নিরাপদ? সরকারের আচরণ দেখে আমার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীই আমাকে দেশে ফিরতে নিরুৎসাহিত করছেন। পদত্যাগের পর যদি দেশে ফিরি, তাহলে আমার ভাগ্যে কী হবে? তখন যদি আমাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়, তাহলে এটা হবে আত্মহত্যার শামিল। আত্মজীবনীমূলক এই বইয়ে এস কে সিনহা আরো লিখেছেন, একদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বার বার আমাকে কেন প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগদেওয়া হয়েছিল- তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি দাবি করব, নিঃসন্দেহে আমার নিয়োগ একটি সঠিক সিদ্ধান্তই ছিল। আমার মেয়াদে আমি অনেকগুলো চাঞ্চল্যকর মামলার রায় দিয়েছি।
এস কে সিনহা দাবি করেছেন, অনেক জটিল আইনগত প্রশ্নের ওপর আমি রায় দিয়েছি, যা বাংলাদেশের অনেক প্রধান বিচারপতি দিতে পারেননি। অধস্তন আদালত থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আমি শৃঙ্খলা এনেছি। সর্বোচ্চ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে আমার মেয়াদে। সঠিক সময়ে আদালত বসতে আমি বিচারকদের বাধ্য করেছি। আমাকে নিয়োগ দেওয়ার পর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল। তিনি বলেছেন, এসব কর্মের পুরস্কার জুটেছে দুর্নীতিবাজ অপবাদ আখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে। তারা আমার মেয়াদ পরিপূর্ণ করতে দেয়নি। আমাকে স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। একজন সাধারণ নাগরিকের মতো আমি একটি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে লাঞ্ছিত হয়েছি। কারণ আমি সুপ্রিম কোর্টকে সরকারের আজ্ঞাবহ হতে দেইনি।
ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়ে এস কে সিনহা বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায় দেওয়ার পর বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটে যায়। একটি দিনের কথা তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার জন্য ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর আমি কোর্টে এলাম। বেলা সাড়ে ১১টায় আমার ব্যক্তিগত সচিব আনিসুর রহমান আমাকে জানালেন যে, দুপুর ১২টায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। আমি তাকে আসার অনুমতি দিলাম। তিনি সময়মতো এলেন এবং আমার কাছে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে তার একজন অফিসারের সঙ্গে কেন খারাপ ব্যবহার করেছি, তা জানতে চাইলেন। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও আমাকে সরাসরি যেভাবে চার্জ করছেন- তাতে হতবাক হয়ে গেলাম। তারপর তিনি আমাকে বললেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। এ কথা শুনে আমি চিৎকার করে বললাম ‘কি! আপনি আপনার সীমা অতিক্রম করছেন। এভাবে কথা বলার ক্ষমতা আপনাকে কে দিয়েছে?’ জবাবে তিনি বললেন, প্রমাণ ছাড়া তিনি কিছু বলেননি। আমি বললাম যে, তার দুঃসাহস দেখে আমি বিস্মিত। এরপর তিনি আমার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এসকে সিনহা লিখেছেন, কোনো বিকল্প খুঁজে না পেয়ে বিচার বিভাগের স্বার্থের কথা চিন্তা করে তিন মাসের পরিবর্তে আমি এক মাসের ছুটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এর প্রেক্ষিতে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। সাধারণত আমার আবেদনপত্র তৈরি করে দেন আমার সচিব। কিন্তু এ সময় তিনি ছিলেন প্রচণ্ড কড়া প্রহরায়। ওই আবেদনে স্বাক্ষর করে আমি দুপুরের দিকে বাসার উদ্দেশে অফিস ছাড়লাম। বাসায় ফিরেই জানতে পারলাম, আমার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ সময় পুরো গৃহবন্দির মতো পরিবেশে আমাকে রাখা হয়। বাইরের কেউ আমার বাসায় প্রবেশ করতে পারেননি। পরের দিন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্যরা। কিন্তু তাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেসব আত্মীয় এসেছিলেন, তাদের গেটে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের ছবি তোলা হয়েছে। তার পরই তাদের কেউ কেউ প্রবেশ করতে পেরেছেন।
এসকে সিনহা বলেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলাম ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর দেশ ছাড়ব। রাত ১১টায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে আমার যাওয়ার কথা। আমাকে বলা হলো, পরিস্থিতি অবনতিশীল। তাদের সঙ্গে কথা না বলে বাসা থেকে বের হওয়া আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলব। এর আগে আমি তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। তা হলো, আমার বক্তব্য মিডিয়ায় ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাই শেষ বিকালে আমার সচিব আনিসুর রহমানকে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলি এবং আমি একটি বিবৃতি প্রিন্ট করি। সেখানে আমি দুটি বিষয় উল্লেখ করি। তা হলো- আমার স্বাস্থ্য ভালো আছে। আগের দিন যেমনটা আইনমন্ত্রী বলেছেন, যেটা আমি মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি যে, তিনি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন পাল্টে ফেলতে চান।
এস কে সিনহা লিখেছেন, সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর আমি মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি যে, সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে আমার বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। বুঝতে পারি যে, আমি মিডিয়াকে বলেছিলাম আমি অসুস্থ নই। তাই আইনমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খবর জেনেছেন। ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অনুগত একাত্তর টিভি একটি টকশোর আয়োজন করে। সেখান থেকে আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রচারণা শুরু হয়।
বইয়ে তিনি দাবি করেছেন, এখন রাষ্ট্রপতি ও সরকারের মদতপুষ্ট মিডিয়া আমাকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। যদি তাদের অভিযোগ সত্যি হয় তাহলে কার কাছ থেকে আমি বেআইনি সুবিধা নিয়েছি? আর এসব অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা হচ্ছে শুধু ষোড়শ সংশোধনীর রায় দেওয়ার পরই। ওই রায় দেওয়ার পর সরকার আমার চরিত্র হননের চেষ্টা করছে বেপরোয়াভাবে। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের অন্যায় ও অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।