• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিস্মিত আওয়ামী লীগ

নতুন কমিটিতে পদবঞ্চিতরা গত সোমবার মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়।

ছবি: ইউএনবি

রাজনীতি

ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিস্মিত আওয়ামী লীগ

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ১৫ মে ২০১৯

ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা। গত সোমবার ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিত ও পদকাঙ্ক্ষিত নেতাকর্মীদের সংবাদ সম্মেলনে সংঘর্ষ, কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া ও না-পাওয়াকে কেন্দ্র করে ‘প্রতিপক্ষের’ বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক পক্ষের বিরুদ্ধে আরেক পক্ষের বিস্ফোরক মন্তব্য ও কমিটি ভেঙে দিতে পদবঞ্চিতদের ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেওয়ার ঘোষণার ঘটনায় তারা বিস্মিত হন। ভ্রাতৃপ্রতিম এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদ্য ঠাঁই পাওয়া কয়েকজনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কয়েকজনকে অবাক করেছে। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কমিটি ঘোষণার পর ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মীর মারামারির ঘটনা শুনে মর্মাহত হন বলে বাংলাদেশের খবরকে জানায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সূত্র।

ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনের প্রায় এক বছর পর নানা যাচাই-বাছাই শেষে পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর কমিটিতে অছাত্র, রাজাকার পরিবার, বিএনপি পরিবারের সদস্য, জামায়াতের ছাত্রসংগঠন শিবির, বিবাহিত ও চাকরিজীবীদের শীর্ষ পদে রাখার যে অভিযোগ উঠেছে, তাতেও বিস্ময় প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিতর্কিত ও সংগঠনের মৌলিক আদর্শবিরোধীরা কীভাবে কমিটিতে ঠাঁই পেলেন, কারা তাদের ছাত্রলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছেন— এমন প্রশ্নও শীর্ষ নেতাদের। দেশের প্রবীণতম এ ছাত্রসংগঠনের সাবেক নেতারাও নতুন কমিটিতে বিতর্কিতদের ঠাঁই পাওয়ায় বিস্মিত। তবে ছাত্রলীগের অভিভাবক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদপ্রাপ্ত সবার বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খোঁঁজ নিতে গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশও দেন বলে জানায় গণভবনের একটি সূত্র।

ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের একটি সূত্র জানায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে গড়া ছাত্রলীগের মতো গণতান্ত্রিক সংগঠনের কমিটিতে পদবঞ্চিত হলে সাধারণত বঞ্চিতরা ক্ষুব্ধ হয়ে নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকেন। পদবঞ্চিতদের সংবাদ সম্মেলনে পদপ্রাপ্তদের ঝাঁপিয়ে পড়ে সংঘর্ষে জড়ানোর ঘটনা এবারের মতো আগে কখনো ঘটেনি। কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়ে পদপ্রত্যাশিত ও পদবঞ্চিতরা গণপদত্যাগের যে হুমকি দিয়েছেন তার দৃষ্টান্তও নেই। এসব ঘটনা নানা বিতর্ক জন্ম দেওয়ার পাশাপাশি ছাত্রলীগের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সংগঠনটিতে অনুপ্রবেশকারীরাই এসব বিতর্কের পেছনের ষড়যন্ত্রকারী বলেও সন্দেহ সংগঠনটির সাবেক নেতাদের।

কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর পদপ্রাপ্ত ও পদবঞ্চিতদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাকে অবশ্য ‘সামান্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষণা নিয়ে যা ঘটেছে, তা একটি ছোট ঘটনা। এটা নিয়ে  উদ্বেগের কিছু নেই। ছাত্রলীগ একটি বড় সংগঠন। এখানে হাজারো নেতাকর্মী আছেন। বয়সে তরুণ হওয়ায় তাদের প্রতিক্রিয়াটা একটু ভিন্ন। যোগ্য নেতারা সবাই পদ প্রত্যাশা করেন। সবাইকে তো আর পদ দেওয়া যায় না। তখন কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হতেই পারেন। যে কারণে এ রকম একটু ঝামেলা হতেই পারে।’

অন্যদিকে গত সোমবার পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর পদকাঙ্ক্ষিত ও পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের সংবাদ সম্মেলনে মারামারির ঘটনায় আহতরা গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। তারা আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০১ সদস্যের নতুন কমিটির সবাইকে অবাঞ্ছিত ঘোষণার পাশাপাশি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাস ছাড়া দলের অন্য কোনো নেতার আশ্বাস মেনে নেওয়া হবে না উল্লেখ করে প্রতিবাদকারীরা বলেন, শুধু শেখ হাসিনা নিজে এ ঘটনার বিচার করলে মেনে নেবেন তারা। আজ বুধবার দুপুর ১টায় রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করবেন বলেও তারা জানান।

গত সোমবারের সংঘর্ষে আহতদের একজন ও নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়া তিলোত্তমা শিকদার গতকালের সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ‘ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিএনপি পরিবার, জামায়াত, অছাত্র, বিবাহিত, চাকরিজীবীদের শীর্ষ পদে রাখা হয়েছে। ছাত্রলীগের ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে নতুন কমিটিতে পদ পাওয়া আমার মতো আরো ৩০ থেকে ৩৫ জন পদত্যাগ করবে।’

পদবঞ্চিতদের কমিটিতে রাখার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, ‘বিতর্কিতদের ব্যাপারে অভিযোগ প্রমাণ হলে পদ শূন্য ঘোষণা করা হবে।’

পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সোমবার মধুর ক্যান্টিনে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত আটজন আহত হন। সোমবার সন্ধ্যার দিকে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে ছাত্রলীগের অন্য একটি পক্ষ বাধা দেয়। এ সময় পদবঞ্চিতদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে ওই রাতেই তিন সদস্যের কমিটি করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তদন্ত কমিটির প্রধান ও ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের খবরকে গতকাল বলেন, ‘এরই মধ্যে ভিডিও ফুটেজ দেখে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। দোষীদের চিহ্নিত করে ও সুষ্ঠু তদন্ত করে আমরা প্রতিবেদন জমা দেব। ছাত্রলীগে এখন পর্যন্ত সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে কেউই ছাড় পাননি, পাবেনও না। কমিটি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সভাপতি লিপি আক্তার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি মানি না। যারা হামলা করেছে, তাদের দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শোভন-রাব্বানীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে আমাদের ওপর হামলা হয়েছে। আবার তারা হামলাকারীদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করেছে।’ ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আড়াই মাস পর গত বছরের ৩১ জুলাই রেজোয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত হয়। ওই দিন গণভবন থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদের নাম ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করেন। গত বছরের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন হয়। রীতি অনুযায়ী ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর দ্রুততম সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার কথা। দলীয় সূত্রমতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও ছাত্রলীগের র্পূণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নির্বাচনকে টার্গেট করে কমিটিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়, পরিচ্ছন্ন ইমেজ ও সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন নেতাদের প্রাধান্য দেওয়ার কথাও ভাবেন নীতিনির্ধারকরা। নির্বাচনের আগে তরুণ ও শিক্ষার্থীদের ভোট টানতে ঢাকাসহ সারা দেশের সংসদীয় আসনে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে কমিটির নতুন নেতারা কমিটি ঘোষণার পরই যেন মাঠে নামতে পারেন, এমন প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হয়নি। ছাত্রলীগের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সাত দিনের মধ্যে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে গত ১৫ এপ্রিল নির্দেশ দিলেও নির্ধারিত সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে সংগঠনটির বর্তমান নেতৃত্ব ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্বই এর মূলে বলে অনেকের ধারণা। নানা আলোচনা ও সমালোচনার পর সম্প্রতি পুরো কমিটি করতে দায়িত্ব দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের চার নেতাকে। ছাত্রলীগের সম্মেলনের এক বছরেও সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে কমিটি করতে না পারায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ওই চার নেতাকে এ দায়িত্ব দেন।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads