• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
লঞ্চের এক ধাক্কায় শেষ হলো পরিবারটি

বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চের ধাক্কায় নৌকাডুবিতে একই পরিবারের ছয়জন নিখোঁজের হওয়ার পর থেকে উদ্ধার অভিযান চালায় নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ

ছবি : সংগৃহীত

দুর্ঘটনা

লঞ্চের এক ধাক্কায় শেষ হলো পরিবারটি

  • রেজাউল করিম হীরা
  • প্রকাশিত ১০ মার্চ ২০১৯

বিয়ের অনুষ্ঠানে আর যোগ দেওয়া হলো না তাদের। বেপরোয়া লঞ্চের ধাক্কায় বিয়ের আনন্দ বিষাদে রূপ নিল শাহজালালের পরিবারের। শুধু তাই নয়, পুরো একটি পরিবারকেই শেষ করে দিল দৈত্যাকৃতির লঞ্চটি। দুই পা হারিয়ে শাহজালাল এখন পঙ্গু। দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে হারাতে হলো। সেই সঙ্গে প্রাণ দিলেন ভাই দেলোয়ার ও তার স্ত্রী-পুত্র।

গত বৃহস্পতিবার রাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শরীয়তপুরে যাওয়ার উদ্দেশে কামরাঙ্গীরচরের বাসা থেকে রওনা দিয়ে নৌকাযোগে সদরঘাটে যাচ্ছিলেন দুই ভাই, তাদের স্ত্রী এবং দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ ৭ জন। সদরঘাটে গিয়ে নৌকা থেকে নামার আগেই সুরভী-৭ লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায় নৌকাটি। এ সময় লঞ্চের পেছনে থাকা পাখার আঘাতে শাহজালালের দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নৌপুলিশের একটি টহল দল শাহজালালকে উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠায়। বাকিরা পানিতে তলিয়ে যান।

খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই সদরঘাটে ছুটে আসেন তার স্বজনরা। সেদিন থেকেই নিখোঁজদের সন্ধানে আসা প্রায় ১০ জন গত দু’দিন সদরঘাটের ১ নম্বর পন্টুনে দিন-রাত অপেক্ষা করছেন। গত শুক্রবার একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গতকাল শনিবার আরো চারজনের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। তবে এখনো সাহেদা নামে এক নারী নিখোঁজ রয়েছেন, যার লাশের অপেক্ষায় স্বজনরা। স্পিডবোট, নৌকা ও ট্রলার নিয়ে সাহেদার লাশ খোঁজা হচ্ছে।

গতকাল সদরঘাটে গিয়ে দেখা যায় নৌকাডুবিতে স্বজন হারানোদের আহাজারি। তাদের একজন নার্গিস আক্তার। আক্ষেপ করে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমাদের পুরো একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল লঞ্চের এক ধাক্কায়। আমরা এখন কী নিয়ে বাঁচব। আমাদের এখন কী হবে।

আরেকজন বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আমরা এখানে বসে আছি (সদরঘাট)। আমাদের পরিবারের এত মানুষ মারা গেল। আমাদের অসহায় করে গেল। কিন্তু কেউ একটু দেখতেও আসেনি। খাওয়া-দাওয়া তো দূরে থাক, পানি পর্যন্ত এনে দেয়নি কেউ। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে আমরা এখানে বসে আছি। তাদের তো আর জীবিত পাব না, অন্তত লাশটা নিয়ে বাড়ি ফিরব এই আশায়।

নিখোঁজদের স্বজনদের অভিযোগ, গত দু’দিন সেখানে অবস্থান করলেও লঞ্চ মালিক কিংবা সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার লোকজন আসেনি তাদের কাছে। স্বজনদের অভিযোগ, এমন একটা বিপদের সময় সাহায্য তো দূরের কথা, খাবার পর্যন্ত পাননি তারা।

নিখোঁজ সাহেদা আক্তারে স্বামী শাহজালাল নৌকা ডুবে যাওয়ার সময় লঞ্চের ইঞ্জিনের পাখায় দুই পা হারিয়ে এখন পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায়। তাদের দুই মেয়ে মীম ও মাহির মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস।

শাহজালালের ছোট বোন মাইসুরা আক্তার বলেন- ভাই মইরলে আমগো মরছে, কার কী আসে-যায়। সবাই আইসা শুধু ছবি তোলে আর চলে যায়। একবার জিজ্ঞেসও করে না আমরা কী হালতে আছি। সঙ্গে যে টাকা ছিল সেগুলো দিয়ে রুটি-কলা খেয়ে আছি। লঞ্চ মালিক বা সরকারের কোনো লোকের দেখা পর্যন্ত পেলাম না যে, তাদের কাছে আমাদের দুঃখটা বলমু।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদরঘাটের বিআইডব্লিউটিএ’র সব কর্মকর্তা-কর্মচারী মুন্সীগঞ্জে বনভোজনে গেছেন। জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক আরিফ উদ্দিন বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী আজ (গতকাল) আমরা মুন্সীগঞ্জে পিকনিকে আসছি। আমাদের আনসার সদস্যরা সার্বক্ষণিক তাদের খোঁজ নিচ্ছেন। তারা তো আমাদের বলেনি যে, তাদের খাবার-পানি লাগবে। এগুলো তো তারা নিজেরাই ব্যবস্থা করেছে শুনেছি। আমরা চেষ্টা করছি সবাইকে দ্রুত উদ্ধার করার। আমাদের ব্যস্ততা ছিল সেদিকে। তাদের আমরা সান্ত্বনা দিয়েছি, কিন্তু মনোযোগ দিয়েছি উদ্ধারকাজে।

গতকাল সকাল থেকে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভেসে উঠছে একের পর এক মরদেহ। মিলেছে পাঁচজনের লাশ, এখনো নিখোঁজ একজন। তাকে উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে ডুবুরি দল। ডুবুরি দলের সদস্যরা ভেসে ওঠা লাশ সদরঘাটের পন্টুনে নিয়ে আসার পরই লাশ বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে আশপাশের পরিবেশ।

সদরঘাট নৌ-পুলিশের পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক জানান, গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৭টায় বুড়িগঙ্গার বাবুবাজার ব্রিজ এলাকায় ভেসে ওঠে শিশু মীমের (৮) মরদেহ। দুপুর পৌনে ১২টায় ভেসে ওঠে মীমের ছোট বোন মাহির (৬) মরদেহ। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টায় ভেসে ওঠে দেলোয়ার (৩৮) ও এর কিছু সময় পর পৌনে ১টার দিকে পাওয়া যায় দেলোয়ারের শিশু জুনায়েদের (৭) লাশ। গত শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে ভেসে উঠেছিল দেলোয়ারের স্ত্রী জামসেদার মরদেহ। এখনো নিখোঁজ একজনের মরদেহের সন্ধান চলছে। নিহতদের মরদেহ উদ্ধারের পর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার মাধ্যমে সুরতহাল করে মিটফোর্ডে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads