• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

দুর্ঘটনা

লেভেলক্রসিংয়ে মৃত্যু অবহেলায়

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২৪ ডিসেম্বর ২০২০

রেলের উন্নয়নে সরকার নানারকমের পদক্ষেপ নিলেও কমছে না রেল দুর্ঘটনা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেলের লেভেলক্রসিংয়ে মৃত্যুর ঘটনা।

জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে লেভেলক্রসিংয়ে কাটা পড়ে মারা গেছে ১২০ জন। যদিও বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশি। লেভেলক্রসিংয়ে এমন মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা অবৈধ লেভেলক্রসিংকে প্রধানত দায়ী করেন। কিন্তু বৈধ ও প্রহরী নিযুক্ত লেভেলক্রসিংয়েও দুর্ঘটনা কম নয়। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। এসব লেভেলক্রসিংয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না বলে বাড়ছে দুর্ঘটনা।

অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের বেশ কিছু আছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তৈরি। গত ১৯ ডিসেম্বর সকালে জয়পুরহাট সদরের পুরানপৈল রেলগেটটিও তেমনি একটি। অবাধে রেলক্রসিংয়ের ওপর উঠে পড়া একটি বাসে ট্রেনের ধাক্কায় বাসের ১২ যাত্রী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো কমপক্ষে তিনজন। ওইদিন সকাল সাতটার দিকে সংঘটিত এই দুর্ঘটনার সময় রেলক্রসিংটির গেট খোলা ছিল, গেটম্যান ঘুমিয়ে ছিলেন বলে জানায় পুলিশ।

পরিসংখ্যান বলছে, বৈধ-অবৈধ সব রেলক্রসিংই অসতর্কতা আর দায়িত্বহীনতার কারণে মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়ায় প্রায়ই। দিনের পর দিন ঘটেই চলেছে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

সাধারণত অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ে রেল নিযুক্ত বা অন্য কোনো গেটম্যান থাকে না। নেই কোনো সতর্কতার ব্যবস্থাও। ফলে হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটে। আবার অনেক বৈধ লেভেলক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান থাকে না, সেখানে পথচারী ও চালকদের সতর্ক করে সাইনবোর্ড বসানো থাকে। সুবিধামতো এমন অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা এড়াতে কোথাও কোথাও রেলের গতি কমিয়ে দিতে হয়। এতে রেল যাত্রায় বিলম্ব হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের কারণে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, কিন্তু এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি সচেতন নয়। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। সবার আগে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ করতে হবে। আর বৈধ ক্রসিংয়ে সার্বক্ষণিক তদারকি করতে হবে।

তবে রেল কর্তৃপক্ষ সচেতন নয়, এমন অভিযোগ মানতে নারাজ বাংলাদেশ রেলের পরিচালক (ট্রাফিক) শফিকুর রহমান। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে এসব দুর্ঘটনা রোধ করা যায়।’

জানা গেছে, দেশে রেলের মোট লেভেলক্রসিং ২ হাজার ৬১২টি। এর মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত লেভেলক্রসিং ১ হাজার ৪১২টি। বাকি ১ হাজার ২০০টি অবৈধ।

স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে রেলপথ ছিল ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার। গত বছরে রেলপথ বেড়েছে ২০০ কিলোমিটার। বর্তমানে মোট রেলপথ ৩ হাজার ১৮ কিলোমিটার। পুরো পথের অনেক জায়গায় ঘন ঘন লেভেলক্রসিং রয়েছে। এমন ক্রসিংয়ের কারণে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দুর্ঘটনা এড়াতে উচ্চ গতিতে চলতে পারে না ট্রেন।

এ ছাড়া এসব ক্রসিংয়ের অনেকগুলো অবৈধ হওয়ায় দেখভালের কেউ থাকে না। আবার স্থানীয় অযৌক্তিক চাহিদাতেও গড়ে উঠেছে লেভেলক্রসিং। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই অবৈধ লেভেলক্রসিং তৈরি হয় বলে অভিযোগ আছে। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও স্থানীয় মানুষেরা নিজেদের প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো রেললাইনের ওপর দিয়ে যাতায়াত করায় গড়ে তোলা হয়েছে লেভেলক্রসিং। এসব অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান কিংবা সতর্কবার্তা থাকে না। ফলে ট্রেন আসার সময় অবাধে রেলক্রসিং পারাপার করে পথচারী ও যানবাহন।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, গত পাঁচ বছরে লেভেলক্রসিংয়ে কাটা পড়ে মারা গেছে ১২০ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরো অনেক বেশি।

প্রতি বছরের হিসাবে ২০১৪ সালে লেভেলক্রসিংয়ে কাটা পড়ে মারা গেছে ৫৪ জন। ২০১৫ সালে মারা গেছে ১৩ জন। ২০১৬ সালে ১৩ জন। ২০১৮ সালে মারা গেছে ১৭ জন। আর ২০১৯ সালে মারা গেছে ২০ জন।

চলতি বছর এ ধরনের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

রেলের একটি তথ্য থেকে জানা যায়, সারা দেশে অবৈধ লেভেলক্রসিং সবচেয়ে বেশি বানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তাদের লেভেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ৫১৬টি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অবৈধ লেভেলক্রসিং ১১টি। ইউনিয়ন পরিষদের অবৈধ লেভেলক্রসিং সংখ্যা ৩৬৩টি। পৌরসভা অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে ৮০টি। সিটি করপোরেশনের অবৈধ লেভেলক্রসিং সংখ্যা ৩৪টি। জেলা পরিষদ অবৈধ লেভেলক্রসিং বানিয়েছে ১৩টি। চট্টগ্রাম বন্দর অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে ৩টি। বেনাপোল বন্দরেরও ১টি অবৈধ ক্রসিং রয়েছে।

জানা গেছে, একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও এসব নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কিন্তু তা খুব একটা আলোর মুখ দেখে না। গত বছরের ১৫ জুলাই সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর পদ্মা ট্রেনের সঙ্গে ১০ জনের মৃত্যু হয়। ওই দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অরক্ষিত রেলওয়ের লেভেলক্রসিংয়ের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে। লেভেলক্রসিংয়ে কোনো ব্যারিয়ার ছিল না। এমনকি সেখানে রেলক্রসিংয়ে কোনো পাহারাদারও ছিল না।’ এমন অনেক প্রতিবেদনে অবৈধ লেভেলক্রসিংকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হলেও পরে তা আগের অবস্থায় রয়ে যায়।

দুর্ঘটনার বিষয়ে বুয়েটের গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘রেলক্রসিংয়ে দিনে দিনে যে মানুষ মারা যাচ্ছে, সেদিকে কারো খুব একটা নজর নেই। এখান থেকে সরে আসতে হবে। রেলে জনবল বাড়াতে হবে। অবৈধ ক্রসিং কমিয়ে আনতে হবে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads