• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
মিশ্র সংকেতে ট্রেন দুর্ঘটনা

সংগৃহীত ছবি

দুর্ঘটনা

মিশ্র সংকেতে ট্রেন দুর্ঘটনা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১১ এপ্রিল ২০২১

ট্রেনের নির্দিষ্ট কোনো সিগন্যাল নেই। পাঁচমিশালি সিগন্যালের কারণেই দেশে বার বার ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সিগন্যালকেই দায়ী করা হয়েছে।  এই অবস্থা থেকে উত্তরণে রেলে এক সিগন্যাল ব্যবস্থার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, রেলে পাঁচ ধরনের সিগন্যাল রয়েছে। এই মিশ্র সংকেতের কারণে দুর্ঘটনা যেমন বাড়ছে তেমনি কমছে ট্রেনের গতি। এ কারণেই মাঝে মধ্যেই বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে ট্রেন। এতে বহু যাত্রী হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগ রেলস্টেশনে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে নিহত হন ১৭ যাত্রী। আহত হন শতাধিক। এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চালকের সিগন্যাল অমান্যকে দায়ী করে রেলওয়ে।

দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে নামে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এই কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে পাঁচমিশালি সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার তথ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে পাঁচ ধরনের সিগন্যাল রয়েছে। কম্পিউটার বেজড কালার লাইট ইন্টার লক, নন-ইন্টার লক, সিমাফোর, সোলার ও বৈদ্যুতিক লাইট। চালকরাও বলছেন, পাঁচমিশালি সিগন্যালের কারণে সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। এসব সিগন্যাল চলছে কম্পিউটারে ও হাতে। সংকেতও ভিন্ন ভিন্ন। এক সিগন্যালে চলন্ত ট্রেন হঠাৎ করে অন্য সিগন্যাল পেলে তা পালন করা দুষ্কর। অনেক সময় অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই ট্রেন চালাতে হয় বলে জানান চালকরা।

সারা দেশের রেললাইনকে এক পদ্ধতির সিগন্যাল ব্যবস্থাপনায় না আনলে দুর্ঘটনা বাড়বে জানিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ম্যানুয়ালি থাকার এখন সুযোগ নেই। অপারেশনটা হতে হবে ডিজিটাল। রেলওয়ের দাবি, সব স্টেশনের সিগন্যাল ব্যবস্থা অধুনিকীকরণের কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী (টেলিযোগাযোগ ও সংকেত) বেনু রঞ্জন সরকার বলেন, নতুন যে রেললাইনগুলো হচ্ছে সেগুলোতে প্রথম থেকেই আধুনিক রেললাইন সিগন্যাল ব্যবস্থা থাকছে। দেশে দুই হাজার ৯২৮ কিলোমিটার রেলপথে স্টেশন রয়েছে ৪৮৩টি। এর মধ্যে ৩৫৩টি স্টেশনে সিগনাল রয়েছে। সবগুলোতে পর্যায়ক্রমে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি টঙ্গীর কাছে মাজুখানে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এতে ১৭০ জন যাত্রী নিহত এবং ৪০০ জন আহত হন। তবে এর আগে স্প্যান ভেঙে পড়ে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৩ সালের ২২ মার্চ ঈশ্বরদীতে। সেতুর স্প্যান ভেঙে কয়েকটি বগি নিচে শুকনা জায়গায় পড়ে যায়। এ দুর্ঘটনায় ৬০ জন যাত্রী নিহত হন।

জানা যায়, চট্টগ্রাম রেললাইনে গত ৩০ বছরে বেশ কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। ১৯৮৯ সালে ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কাছাকাছি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ১৩ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হন। এই একই লাইনে ২০১০ সালে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর ট্রেন ‘মহানগর গোধূলি’ ও ঢাকাগামী মেইল ‘চট্টলা’র মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এ ঘটনায় চট্টলা ট্রেনের একটি বগি মহানগর ট্রেনের ইঞ্জিনের ওপরে উঠে যায়। সেই দুর্ঘটনায় চালকসহ মোট ১২ জন নিহত হন।

এছাড়া, উত্তরবঙ্গেও বেশকিছু ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ‘হিলি ট্র্যাজেডি’ নামে পরিচিত ১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী ৫১১ নম্বর লোকাল ট্রেনটির দুর্ঘটনা। এ ঘটনায় পার্বতীপুরগামী ট্রেনটি হিলি রেলস্টেশনের এক  নম্বর লাইনে এসে দাঁড়ায়। এর কিছুক্ষণ পর সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী আরেকটি আন্তঃনগর সীমান্ত এক্সপ্রেস একই লাইনে ঢুকে পড়ে। এসময় মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটলে  অর্ধশতাধিক যাত্রী নিহত হন।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ট্রেন দুর্ঘটনার বিষয়ে বলেন, ‘সবচেয়ে নিরাপদ মনে করা হয় ট্রেনকে। মাঝে মাঝে কিছু দুর্ঘটনায় অনেক মানুষের প্রাণ যায়। আর যারা আহত হন তারা আরও দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন। তাদের খোঁজও আমরা রাখি না।’

দুর্ঘটনাকে ভয়াবহতার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এরচেয়ে প্রাণের ক্ষতি অন্য দুর্ঘটনায় বেশি ঘটলেও ভয়াবহতার দিক দিয়ে এটি অনেক এগিয়ে।’

মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ট্রেন দুর্ঘটনা বেশিরভাগই হয় লাইনচ্যুত হয়ে বা মুখোমুখি সংঘর্ষে। রেলের গাফিলতি নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত কথা বললেও খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। রেলে অনেক বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনটা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, সেটায় মনোযোগ তাদের নেই।’

রেল গবেষক ও ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের প্রকল্প কর্মকর্তা মো. আতিকুর রহমান তার অভিজ্ঞতা থেকে মনে করেন, ট্রেনচালকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও তারা বয়স্ক হওয়ায় এধরনের দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। লোকবল সংকটের কারণে এদেরকে গ্রেড দিয়ে উন্নীত করার মতো বিষয়গুলো এজন্য দায়ী। সিগন্যাল ব্যবস্থার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘সিগন্যালিং ব্যবস্থায় সমস্যা রয়ে গেছে। এধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসল কারণ আড়ালে চলে যায়। ট্রাফিকিং বিভাগ, মেকানিক্যাল, সিগন্যালিং ও মেইনটেনেন্স বিভাগ একে অপরকে দোষ দিতে থাকে।’

তিনি আরো  বলেন, ‘দুর্ঘটনা ঘটার পরের যে প্রস্তুতি সেটি আমাদের একেবারেই নেই। দুর্ঘটনায় যদি আগুন ধরার মতো ঘটনা ঘটতো, সেক্ষেত্রে ট্রেনের মধ্যে আগুন নির্বাপণের সক্ষমতা কি আমরা রাখি? দুর্ঘটনার পর ট্রেনটিকে সরিয়ে নেওয়াটাই একমাত্র পরিত্রাণ হয়ে দাঁড়ায়। সার্বিকভাবে আমরা রেল বিভাগের গাফিলতি দেখতে পাই।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads