• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

দুর্ঘটনা

অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে বৈদ্যুতিক ত্রুটি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৩ জানুয়ারি ২০২২

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের অধিকাংশই ঘটছে বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে। একাধিক দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণে ওঠে এসেছে এই তথ্য। ২০২১ সালে চট্টগ্রামে অগ্নিকাণ্ডের প্রায় ৫০ শতাংশই বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে হয়েছে বলে মনে করে ফায়ার সার্ভিস। আর চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) তথ্য মতে চট্টগ্রামে অগ্নিকাণ্ডের ৬৬ শতাংশই হলো বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে।

ফায়ার সার্ভিস ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন,  ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার বা ওভারলোডিং, ত্রুটিপূর্ণ লাইন, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার,  নিয়মিত বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের লাইন ও যন্ত্রপাতি চেকআপ না করার কারণে চট্টগ্রামে বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ড। সেই সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসকে আরো শক্তিশালী করা এবং তাদের ফায়ার ইকুইপমেন্টের যে অভাব আছে, তা দ্রুত  পূরণ করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি চুয়েট ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে আগুনের ঝুঁকি’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামে ২০১৫ সাল থেকে গত পাঁচ বছরে দুই হাজার ৫১৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যার ৬৬ শতাংশই হলো বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে। বাকি ১১ শতাংশ রান্নাঘরের আগুন, ১৩ শতাংশ বিপজ্জনক উপাদান (রাসায়নিক পদার্থ), ৯ শতাংশ সিগারেটের আগুন আর ১ শতাংশ অন্যান্য কারণে হয়ে থাকে।

অগ্নিকাণ্ডের ৪৭ শতাংশ ঘটে আবাসিক এলাকায়, বাণিজ্যিক এলাকায় ঘটে ২৭ শতাংশ। এ সময়ে (গত পাঁচ বছর) চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় আহত হন ৮৩ জন এবং মারা যান ১৫ জন।

২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত নয়টি ফায়ার স্টেশনের তথ্য নিয়ে এ গবেষণা কার্যক্রম চালানো হয়।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে, ২০২১ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে এক হাজার ৯০০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের ৮৫৮টি ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া ৩৭০টি সিগারেট ও ১৪৭টি চুলার আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম জেলায় ৬৭০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বৈদ্যুৎতিক গোলযোগ থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটে ৩৩২টি। এছাড়া কুমিল্লায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ৬৩৫টি, নোয়াখালীতে ২৯৮টি, রাঙামাটিতে ৯৭টি, বান্দরবানে ৪০টি ও কক্সবাজারে ১৭০টি।

ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত বছর যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে তার বেশির ভাগই বৈদ্যুতিক কারণে। যার অন্যতম কারণ ওভারলোডিং। দেখা গেছে, এক বাসা-বাড়িতে ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বৈদ্যুতিক চুলা, ফ্রিজসহ বিদ্যুৎচালিত বিভিন্ন জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বৈদ্যুতিক তার যেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো সঠিক মানের না বা লোড নিতে পারছে না। ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত নয়টি ফায়ার স্টেশনের পাঁচ বছরের তথ্য নিয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে আগুনের ঝুঁকি’ শীর্ষক এক গবেষণা চালায়। চুয়েটের নিজস্ব অর্থায়নে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান ও মো. রাকিবুল হাসান কাউসার গবেষণাটি পরিচালনা করেন।

২০২০ সালের আগস্টে গবেষণাটি জার্মানভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। গবেষণায় বলা হয়, চট্টগ্রামে নগর উন্নয়নের হার অনেক বেশি। শহরে নগরায়ণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও। গত পাঁচ বছরে শহরাঞ্চলে অগ্নিদুর্ঘটনার সংখ্যা দুই হাজার ৫১৪টি।

গবেষণায় বলা হয়, বিগত পাঁচ বছরে (২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল) বেশির ভাগ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বৈদ্যুতিক লাইনে ত্রুটি বা শর্ট সার্কিট থেকে। এসব অগ্নিকাণ্ডের অধিকাংশ ঘটেছে শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৭ কোটি ৯০ লাখ ৯১ হাজার ২০০ টাকা।

গবেষণায় আরো জানা যায়, সিটি করপোরেশনের ১৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় কাজ করে মাত্র নয়টি ফায়ার স্টেশন। গবেষণায় ওঠে আসে, আবাসিক এলাকায় আগুনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অধিক জনসংখ্যা ও অবকাঠামোগত দিক থেকে এসব অঞ্চল আগুনের ঝুঁকির জন্য বেশি সংবেদনশীল। গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার মোট অগ্নিদুর্ঘটনার মধ্যে ৪৬ শতাংশ আবাসিক এলাকায়, ২৭ শতাংশ বাণিজ্যিক এলাকায়, ১৩ শতাংশ মিশ্র ব্যবহূত এলাকায়, ১১ শতাংশ শিল্প এলাকায়, ২ শতাংশ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশ পাকা বাড়ি, ৩৩ শতাংশ সেমিপাকা এবং ৩০ শতাংশ কাঁচাঘরে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় আগুনের ঝুঁকির বিষয়ে ওই গবেষণার গবেষক এবং চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, চট্টগ্রাম নগরে গত পাঁচ বছরে প্রায় দুই হাজার পাঁচশর অধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ ঘটেছে আবাসিক এলাকায়। মূলত বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে বেশির ভাগ আগুনের সূত্রপাত।

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বৈদ্যুতিক খুঁটির মধ্যে তারের জঞ্জাল থেকে শর্টসার্কিট হয়। সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত। এছাড়া বৈদ্যুতিক তারসহ অন্যান্য জিনিস নিম্নমানের হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

বাসা-বাড়িতে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে চুয়েটের এ শিক্ষক বলেন, বাসা-বাড়িতে ওভারলোডিংয়ের কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এছাড়া তারের সংযোগ যথাযথ না হওয়াও অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি ছাড়াই সংযোগ নেওয়া হয়। ফলে সংযোগ ঠিক মতো না হওয়ায় সেখানে শর্টসার্কিট হয়। অথবা স্কচ টেপ ঠিক মতো ব্যবহার না করায় বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়। এর ধারেকাছে শুকনা কিছু থাকলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে কীভাবে রক্ষা করা যায় এ সম্পর্কে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম বিতরণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান সামিনা বানু বলেন, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা এড়াতে নগরবাসীকে কিছুদিন পরপর সংযোগ লাইন এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জামগুলো পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের সংযোগে ওভারলোডিং বা যেকোনো দুর্ঘটনা রোধে সার্কিট ব্রেকার কিংবা অন্য কোনো ডিভাইস ব্যবহারসহ নিম্নমানের তার এড়িয়ে চলারও পরামর্শ দিচ্ছি আমরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads