• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে তারকাদের শোক

সংগৃহীত ছবি

বলিউড

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে তারকাদের শোক

  • বিনোদন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর ২০২০

চলে গেলেন বাংলার প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা, নাট্যকার, বাচিকশিল্পী, কবি ও চিত্রকর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গতকাল রোববার ভারতীয় সময় দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ৮৬ বছরে বয়সে শেষ হলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কর্মময় দীর্ঘ পথচলা। বাংলা সিনেমার এই কিংবদন্তির মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে বাংলাদেশসহ ভারতীয় সিনেমার আঙিনায়। শোক প্রকাশ করছেন নানা অঙ্গনের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা। প্রিয় অভিনেতাকে হারিয়ে ব্যথার সাগরে ভাসছেন সৌমিত্রের ভক্তরা।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার খবরে অনেকের মতো বিরহকাতর বাংলাদেশের বরেণ্য অভিনেত্রী ববিতাও। তিনি ‘অশনিসংকেত’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী ‘অনঙ্গ বউ’য়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি পরিচালনা করেন সত্যজিৎ রায়। ছবিটির জন্য অস্কার পান পরিচালক। এই ছবির মাধ্যমেই বাংলাদেশ ছাড়িয়ে ববিতার নাম ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ব্যাপক উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে দিন পার করছিলেন অভিনেত্রী ববিতা। তিনি বলেন, ‘যখন থেকে শুনলাম সৌমিত্র দা হাসপাতালে তখন থেকেই তার জন্য দোয়া করে যাচ্ছিলাম- তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। কিন্তু তিনি ফিরলেন না। সবাইকে ছেড়ে চলেই গেলেন। খুব মন খারাপ লাগছে।’

ক্যারিয়ারে একটি ছবি ববিতার সঙ্গে করলেও উভয়ের মধ্যে বেশ সখ্য ছিল। যোগাযোগ বেশ আন্তরিক ছিল। সৌমিত্র যখনই বাংলাদেশে কোনো কাজে আসতেন ববিতার সঙ্গে দেখা হতো, দীর্ঘ সময় আড্ডাও হতো।

সৌমিত্রের স্মৃতিচারণ করে ববিতা বলেন, “সৌমিত্রদার সঙ্গে আমার কত স্মৃতি... এগুলো কয়েক মিনিটে বলা সম্ভব নয়। আজ অশনিসংকেত ছবির শুটিংকালীন অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছে। অশনিসংকেত ছবির দৃশ্যধারণ হয়েছিল শান্তিনিকেতন ও বীরভূমে। সিনেমার যেখানে চিত্রায়ণ হয়েছে, সেই সেট ছিল ছবির মতো সাজানো-গোছানো। ছবিতে যখন অভিনয় করি, তখন আমার বয়স কম ছিল। সত্যজিৎ দা, সৌমিত্র দা আমাকে কতটা সাহায্য করেছেন তা বলে বোঝানো যাবে না। তারা ছিলেন বলেই আমি ‘অনঙ্গ বউ’ হয়ে উঠতে পেরেছিলাম।”

তিনি বলেন, বেশ ব্যক্তিত্ববান ছিলেন সৌমিত্র। সংস্কৃতির সকল শাখা-প্রশাখা নিয়ে তার জানাশোনা। তিনি কথা বললে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। দারুণ কবিতা আবৃত্তি করতেন, লিখতেনও। এই মানুষটি এখন অতীত। তবে সৌমিত্র চলে গেলেও তিনি অমর হয়ে থাকবেন। তার মতো নক্ষত্ররা সব সময় আলো ছড়িয়ে যান। তিনিও যাবেন।

তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন ঢাকাই সিনেমার এক সময়ের ব্যস্ত নায়ক ওমর সানী। সত্যজিৎ রায়ের অপুর সঙ্গে কলকাতার দুটি সিনেমায় অভিনয় করেন সানী। বলছিলেন সেই সময়ের কথা।

ওমর সানী ফেসবুকে বলেন, সৌমিত্র দা একটা ইতিহাস, ভারতবর্ষের অভিনয়ের একটা ডিকশনারি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কলকাতার লোকাল প্রোডাকশনের দুটি ছবি করার। কো-আর্টিস্ট হিসেবে দাদাকে পেয়েছিলাম। উনাকে দেখার পর আমি তাকিয়ে থাকতাম। আমাকে বলত, কিরে কী দেখছিস? আমি বলতাম, দাদা তোমাকে দেখি, আমার এত বড় সৌভাগ্য হলো তোমার সাথে অভিনয় করার। আমার জীবন সার্থক। ওমর সানী আরো বলেন, সচরাচর প্রম্পটিং শুনে আমরা অভিনয় করি। উনি আমাকে ডাকলেন, বললেন- কিরে তোর মাথায় কিছু নেই রে শুধু গোবর। আমি লজ্জায় মাথানত করতাম। অভিনয় করার সময় শুধু পানি খেতাম। আমাকে বলত, কিরে এত পানি খাচ্ছিস কেন, কোনো প্রবলেম? আমি বলতাম, না দাদা তোমাকে দেখে আমার গলা শুকিয়ে যায়। অট্টহাসি দিত এবং আদর করত। অনেক বছর গ্যাপ, খুব ইচ্ছে ছিল কলকাতায় গিয়ে দাদার আশীর্বাদ নিয়ে আসব। আর হলো না, দাদা তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা পুরো বাংলা ভাষাভাষী মানুষের শ্রদ্ধা, বিগ বস।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলেন, যখন খুব কাছের মানুষ কেউ চলে যায়, তখন সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। ঠিক যেমনটা জানে না, কী বলবে, কী করবে। আমার অবস্থাটা সেরকমই। ঠিক বুঝতে পারছি না কী বলব এই মুহূর্তে, কীভাবে যে সামলাবো সেটাও বুঝতে পারছি না। মনটা অনেকদিন ধরেই খারাপ ছিল। তিনি অনেকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। যখনই অসুস্থ হয়েছেন তখনই প্রার্থনা করেছি, যেন উনি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যান। এই লম্বা পরিসরে তিনি অনেকবার অসুস্থ হলেও বারবারই তিনি হাসি মুখে ফিরে এসেছেন। আমাদের কখনই নিরাশ করেননি। কিন্তু আজকে একেবারেই নিরাশ হয়ে গেলাম।

তিনি বলেন, ২৫-২৬ বছর আগে যখন প্রথম অভিনয় জগতে এলাম, সেদিন থেকেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আদরের স্পর্শ পেয়েছি। এতো ভালোবাসা, এতো শিক্ষা- জানি না খুব অন্য কারো কাছে পেয়েছি কি না। একটা বয়স থেকে আরেক বয়সে পৌঁছানো, আমি ছোট থেকে বড় এই দীর্ঘ সময় ধরে তাকে দেখেছি। এ যেন এক অদ্ভুত সম্পর্ক।

অভিনেত্রী আরো বলেন, আমার প্রথমে সেই নিউ কামার হিসেবে আসা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভয়ে ভয়ে অভিনয় করা। সে সময় ‘শ্বেতপাথরের থালা’র পাশাপাশি ‘শেষ চিঠি’ বলে একটা ছবিতেও কাজ করেছিলাম। তনুজা আনটি এবং সৌমিত্র কাকার সঙ্গে কাজ করা এটা আমার অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল। পরবর্তীকালেও তার অনেক কাজ করেছি। পরে আমি সৌমিত্র কাকাকে বলেছি, ‘এতো হ্যান্ডসাম ম্যান’ আমি আমার লাইফে দেখিনি।

কিংবদন্তি এই শিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন শর্মিলা ঠাকুর।

সৌমিত্রের সুদীর্ঘ ছয় দশকের ক্যারিয়ারে ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘বর্ণালী’, ‘অরণ্যের

দিনরাত্রি’, ‘আবার অরণ্যে’সহ একাধিক জনপ্রিয় ছবিতে সহ-অভিনেত্রী ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। সৌমিত্র-শর্মিলা জুটি দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। সৌমিত্রের প্রয়াণে ভেঙে পড়েছেন শর্মিলা।

ভারতীয় গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে শর্মিলা ঠাকুর বলেন, ‘ভীষণ ভীষণ খারাপ লাগছে। আজ আমার জীবনের এক গভীর শোকের দিন। অনেক দিন ধরেই ভুগছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠবেন। উনি ছিলেন আমার বহু পুরনো বন্ধু। উনার মতো কে আছে আর? উনার অভিনয়, নাট্য পরিচালনা, সাহিত্য যা অবদান, তা যে ঐতিহ্যের পত্তন করেছে, তা চিরন্তন। উনার আবৃত্তি অসাধারণ। উনি চলে গেলেন, কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেক দিন উনি বেঁচে থাকবেন। আজ আমি অত্যন্ত শোকাহত, বড় দুঃখের দিন। অরণ্যের দিনরাত্রি ছবির শুটিংয়ে উত্তরবঙ্গের এক ডাকবাংলোয় সৌমিত্র, শুভেন্দু ও আমি ছিলাম। রোজ কাজের পরে আমাদের আড্ডা জমত নানান বিষয়ে। উনি এত বিষয়ে গভীরভাবে জানতেন যে, বার বার মুগ্ধ হয়েছি। এই অভাব অপূরণীয়।’

জনপ্রিয় অভিনেত্রী রুমানা রশীদ ঈশিতা ২০১৮ সালে ‘কাঠপেন্সিল’ নামের একটি টেলিছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। এ অভিনেত্রী বলেন, ‘যখন আমার কাছে স্ক্রিপ্ট পাঠানো হয়, তখন শুনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এতে অভিনয় করবেন। আমি আর বেশি কিছু ভাবিনি। সঙ্গে সঙ্গে বলেছি, আমি কাজ করব। এখনো মনে হয়, সেই সিদ্ধান্তটা আমার জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি হয়ে আছে যে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষের সঙ্গে আমি কাজ করতে পেরেছি।

আমাদের শুটিং হয়েছিল কলকাতায়। উনার বয়স তখন ৮৩ বছর। সেই বয়সেও তার সময়-নিয়মানুবর্তিতা, পেশাদারিত্ব আমাকে মুগ্ধ করতো।

শুধু সেটে আসাই নয়, আসার আগে তিনি আরও প্রস্তুতি নিয়ে আসতেন। কারণ কখনো দেখিনি তার একটা সংলাপ ভুল হয়েছে। সবকিছুই মুখস্থ ও আত্মস্থ করে সেটে ঢুকতেন। আমরা তখনো জানতাম না, তিনি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন বা তার কাজেও সেই ছাপ পাওয়া যেত না।

আরেকটি বিষয় বলি, সেটে আমরা সবাই উনার অনেক ছোট। আমার চেয়েও বয়সে ছোট টেলিছবিটির পরিচালক রাফায়েল আহসান। কিন্তু সৌমিত্র কখনোই ডিরেক্টরের কথার বাইরে কিছু করতেন না। এবং নির্দেশনাগুলো শুনে বুঝে নিতেন।

শুটিংয়ের ফাঁকে ঈশিতা, অন্তু ও সৌমিত্র প্রায় প্রতিটি শট দেওয়ার পরই আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, কোনো কিছু মিস হলো কিনা? পরিচালককে বলতেন, আবার শট দিতে হবে কি না! অথচ উনার মতো অভিজ্ঞ মানুষের তো মিস হওয়ার কোনো সুযোগই থাকে না। তার মতো বিখ্যাত মানুষের তো অন্যের কাছে মতামত নেওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। কিন্তু তিনি তা করতেন। বিনয়ের সঙ্গেই করতেন। সৌমিত্র একটা প্রতিষ্ঠান। যার পাশে থাকলেও অনেক কিছু শেখা যায়। আমার পরম সৌভাগ্য, সেই দুদিন সুযোগটা পেয়েছি। ভালো থাকবেন প্রিয় অভিনেতা।

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র জগতের বিশাল সেই ‘গাছ’ বা মহীরুহের পতন ঘটল।

চিত্রনায়ক শাকিব খান সৌমিত্রের চলে যাওয়ার খবরে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যেখানে থাকেন, যেভাবেই থাকেন, আপনি আমাদের হূদয়েই থাকবেন। বিদায় হে বরেণ্য!’ চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ সৌমিত্রকে বিদায় জানিয়েছেন এভাবে, ‘ভালো থাকবেন পুরোনো বন্ধুদের সাথে, বেলা শেষে দেখা হবে...।’

দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পর্দায় তিনি যখন অভিনয়ের গরিমা ঝেড়ে ফেলে চরিত্রের আচরণ ফুটিয়ে তুলেছিলেন, ভারতবর্ষের শিল্পভুবনে সেটা শুধু বিস্ময়কর একটা ঘটনাই ছিল না, ছিল এক নতুন যুগের শুরু। বিশ্ব-চলচ্চিত্রের অভিনয়ের প্রথম সারিতেই তাঁর স্থান। কিন্তু অমন যে ইতিহাসের স্রষ্টা, অমন যে শিখরে ওঠা শিল্পী, মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন এক মহাসাগর। যে মহাসাগর অতলান্ত, কিন্তু শান্ত। তাঁর মৃত্যু নেই!’

অভিনেত্রী রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা লিখেছেন, ‘শান্তিতে বিশ্রাম নিন এই সময়ের সবচেয়ে গৌরবময় মানুষ।’ অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব লিখেছেন, ‘একটি যুগের সমাপ্তি। তাঁর আত্মা চিরন্তন শান্তিতে বিশ্রাম নিক, সৌমিত্র চ্যাটার্জি।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads