• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
লক্ষ্যে স্থির থাকলে স্বপ্ন পূরণ হবেই

সংগৃহীত ছবি

ক্যাম্পাস

লক্ষ্যে স্থির থাকলে স্বপ্ন পূরণ হবেই

  • প্রকাশিত ২৬ এপ্রিল ২০২১

ছেলেটির যখন ৮ বছর বয়স, তার বাবা তখন মাউন্ট এভারেস্টের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন, তুমি কি পারবে এর চূড়ায় উঠতে? ছেলেটি দৃঢ়স্বরে বলেছিল, হ্যাঁ, পারব। দৃঢ় স্বপ্নকে বাস্তবায়নে স্কুল জীবন শেষ হতেই ইন্ডিয়ান আর্মির সিকিম ডিভিশনে ভর্তি হওয়ার মনস্থির করল। যেন হিমালয়কে আরো কাছে থেকে জানা যায়। কিন্তু নানান কারণে আর ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠেনি ছেলেটির। কিন্তু হতাশাকে পুঁজি করে কিছুদিন পর ব্রিটিশ আর্মির এয়ার ডিভিশনে যোগ দিলেন। আর মনে মনে হিমালয় জয় করার স্বপ্নের বীজ বুনতে থাকল। ষোলো হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল ছোট্ট একটি উড়োজাহাজ। ধীরে স্বস্তিতে খুলে গেল উড়োজাহাজের দরজা। সুদর্শন চেহারার এক তরুণ লাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। শেষবারের মতো প্রার্থনা করে লাফ দিল সে। জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর একটা উপভোগ করতে যাচ্ছে এসএসআর-এর সর্বশেষ ট্রেইনি। প্যারাস্যুটের রশি ধরে টান দিতেই সে বোঝা গেল, গোলমাল রয়েছে। প্যারাস্যুট খুলছেই না! আবারো চেষ্টা, নাহ! এবারো খুলছে না। শেষবারের মতো হ্যাঁচকা টান দিয়ে খোলার চেষ্টা করলে হুট করেই খুলে যায় প্যারাস্যুট। কিন্তু মাটি ছোঁয়ার আগে যতটুকু কম গতি প্রয়োজন, তা থেকে দূরেই রয়ে গেলেন। সোজা গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল ছয় ফুটের দেহটা। শরীরের হাড় যেন একেবারে চুরচুর হয়ে গিয়েছে! স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। মেরুদণ্ড দুমড়েমুচড়ে গিয়েছে, ভেঙে গিয়েছে তিনটি কশেরুকা। ডাক্তাররা বলেছিল, আর কোনদিন হাঁটতে পারবে না। আর্মির চাকরিটিও ছেড়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু এই দুর্ঘটনাই যেন জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল তার। ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছার জোরে দুর্ঘটনার কবলে পড়ার দেড় বছরের মাথায় ছেলেটির আজীবনের স্বপ্ন এভারেস্ট জয় করেছিল। সবচেয়ে কম বয়সি (২৩) এভারেস্টে ওঠার (১৬ মে ১৯৯৮) রেকর্ড করেন তিনি (যদিও গত বিশ বছরে রেকর্ডটি আরো চার বার ভাঙা হয়েছে)। সেই ছেলেটি আর কেউ নয়। তিনি হলেন বেয়ার গ্রিলস। স্বপ্ন দেখ পূরণ করার জন্য। স্বপ্ন দেখ বাস্তবায়নের জন্য। লক্ষ্যে স্থির থাকলে স্বপ্ন পূরণ হবেই। কীভাবে হবে জানি না, কিন্তু হবেই।

অ্যাডভেঞ্চারের নেশা : এডওয়ার্ড মাইকেল গ্রিলস আয়ারল্যান্ডের ছোট্ট শহর ডোনাদিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে নানীর কাছে চার বছর কাটিয়ে পাড়ি জমালেন ইংল্যান্ডের দক্ষিণে, আইল অফ উইটে। সাগরের চারপাশে যাপনের ফলেই হয়তো সাগরের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। এছাড়া বাবা মাইকেল গ্রিলসও রয়্যাল ইয়ট স্কোয়াড্রনের একজন সদস্য ছিল। সেই সুবাধে অ্যাডভেঞ্চারের নেশার হাতেখড়িটাও পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকেই। নানী প্যাট্রিশিয়া ফোর্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের প্রথম নারী এমপি, অন্যদিকে বাবা মাইকেলও যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ; সেজন্য স্বভাবতই রাজনীতির হালকা আঁচড় তার মাঝে থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু না! অ্যাডভেঞ্চারের নেশা এই কারাতের ব্ল্যাকবেল্টকে এসব আটকে রাখতে পারেনি। কলেজে থাকতে থাকতেই গঠন করেছেন পর্বতারোহীদের ক্লাব। কিশোর বয়সেই নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের স্কাউট দলকে। পড়াশোনা শেষ করে ছুটে গিয়েছিলেন ভারতে। সিকিম আর দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো বেয়ার ভারতের নাগরিক না হওয়ার কারণে আর্মড ফোর্সে সুযোগ পেলেন না। কিন্তু শেষমেশ ঢুকে পড়লেন ব্রিটিশ আর্মিতে। তারপর ব্রিটিশ আর্মির স্পেশাল এয়ার সার্ভিসের তিন বছরের জীবন তাকে পরিণত করল ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্কাইডাইভারে। আর সেই স্কাইডাইভিং করতে গিয়েই জাম্বিয়ায় প্যারাস্যুট দুর্ঘটনা। অতঃপর শুরু হল নতুন অভিযানের কাব্য।

অভিযাত্রীর ডায়েরি : তেইশ বছর বয়সে হিমালয় জয়ের মাধ্যমেই বেয়ার বড়সড় অভিযানের সূচনা করেন। তারপর শুধু রেকর্ড ভাঙার পালা। বলা যায়, জীবনে যত ধরনের অ্যাডভেঞ্চার করা সম্ভব, কিছুটা হলেও সবকিছুই করেছেন। হিমালয় জয়ের পরপরই পুরো বিশ্বের মতো গ্রেট ব্রিটেনে ব্যাপক হইচই শুরু হয়ে যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রয়্যাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশনের তহবিল গঠনের জন্য জেট স্কি নিয়ে তিনি চক্কর দিয়েছেন ব্রিটিশ আইলের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। দুর্ঘটনায় পা হারানো বন্ধুর সাহায্যের জন্য নগ্ন হয়ে নেমে গিয়েছেন শীতল টেমস নদীতে! সাগরের নীল পানিকে আপন করেই তিনি ছোট্ট বাতাস ভরা নৌকা দিয়ে উত্তর মেরুর বরফ কেটে বেরিয়ে এসেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমি অ্যান্টার্কটিকা পাড়ি দিয়েছেন জেট স্কি দিয়ে। এমনকি বরফশীতল হিমালয়ের ওপর সর্বোচ্চ উচ্চতায় প্যারাগ্লাইডিং করার রেকর্ডটাও তার দখলে। ইংল্যান্ডের এক দাতব্য সংস্থার অর্থ তহবিলের জন্য অক্সিজেন মাস্ক নিয়েই বেলুনে চড়ে ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায় ডিনার করেছিলেন তিনি!

ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড : এভারেস্ট জয় কিংবা মেরু অভিযান, কোনোটিই হয়তো বেয়ারকে ততটা খ্যাতি এনে দিতে পারেনি; যতটা এনে দিয়েছে ডিসকাভারির ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানটি। প্রতিকূল পরিবেশ কিংবা দুর্গম অঞ্চল থেকে কীভাবে বেঁচে ফেরা যায় তার চিত্রায়ন করতেই বেয়ার গ্রিলস ছুটে গিয়েছেন গ্রেট ক্যানিয়নে, পুড়েছেন তীব্র রোদে, খাবি খেয়েছেন আল্পসের বরফগলা পানিতে, তাড়া খেয়েছেন আফ্রিকার সাভানায় হাতি-সিংহের কাছ থেকে, মশার কামড় খেয়েছেন কোস্টা রিকার রেইনফরেস্টে, রাত কাটিয়েছেন আইসল্যান্ডের বরফের গুহায়, মানুষখেকো বুশম্যানদের পাল্লায় পড়েছেন নামিবিয়ায়, নগ্ন হয়ে সাঁতার কেটেছেন সাইবেরিয়ার মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, সাপ খেয়েছেন সিয়েরা নেভাডার প্রান্তরে, প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ পার করেছেন সামান্য ভেলার সাহায্য নিয়ে। পদে পদে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে প্রকৃতির একেবারে গভীরে মিশে যাওয়া বেয়ারকে টেলিভিশনের পর্দায় যে মুগ্ধতা নিয়ে দর্শক দেখে, সেই মুগ্ধতা মিথ্যে নয়। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ভয়াবহ প্যারাস্যুট দুর্ঘটনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটি কথাই বলেছিলেন তিনি, ‘IF YOU RISK NOTHING, YOU WILL GAIN NOTHING.’

ফারজানা আক্তার কনা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads