শিশুর জন্মের ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধই একমাত্র পুষ্টিকর খাবার। এরপর বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি ও সুষম খাবার না দিলে শিশুর স্বাস্থ ভালো থাকবেনা ও সে ঘন ঘন অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হবে। আসুন জেনে নিই শিশুর এই বাড়তি খাবার সমূহ কেমন হবে।
শিশুর বাড়তি খাবারের প্রয়োজন কেন?
একটি শিশুর শারিরীক বৃদ্ধি এবং মানসিক বিকাশ জীবনের প্রথম বছরে পরবর্তী বছরগুলোর তুলনায় অতি দ্রুত ঘটে। শিশু জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ ব্যতিত অন্য কোন খাবার গ্রহনের দরকার পড়েনা, শুধু মায়ের দুধই পর্যাপ্ত খাদ্য উপাদানের যোগান দিয়ে থাকে। এমনকি এসময় বাড়তি পানিরও প্রয়োজন পড়েনা। তবে শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে তাঁর চাহিদা একমাত্র মায়ের দুধে মেটে না। তাই শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে স্বাস্থ ভালো রাখতে ও তার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই মায়ের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার দিতে হবে।
ছয় মাস বয়সী শিশুর খাবার কেমন হবে?
একটু বড় হলেই মা বাবাকে তাঁর শিশুর খাবারের স্বাদ আর পুষ্টিগুণ নিয়ে টেনশন করতে দেখা যায়। শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য তাঁর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলেই মায়ের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক বা বাড়তি খাবার দেওয়া উচিত। পুষ্টিকর খাবার ও সলিড জাতীয় খাবারের প্রতি বাচ্চাদের এসময় অনিহা দেখা যেতে পারে। তাছাড়া সঠিকভাবে ও পরিমাণ মতো খাবার না দিলে শিশুর স্বাস্থ ভালো থাকবেনা। তাই এসময় অভিবাবকদের শিশুর প্রতি খুবই যত্নবান হতে হবে। শিশুকে ধীরে ধীরে মায়ের দুধের পাশাপাশি নতুন নতুন খাবারের প্রতি অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে শিশুদের জন্য মুখরোচক খাবারের তালিকা তৈরি করে নিতে হবে। এসময় বাচ্চাদের হজম করার ক্ষমতা বড়দের মত হয় না। অার হজম না হলে বদহজম হয়ে শিশুর স্বাস্থের অবনতি ঘটতে পারে। তাই এসময় বাচ্চাদের জন্য এমন খাবার বেছে নেয়া উচিত যা মায়ের দুধের সাদৃশ্যপূর্ণ অর্থাৎ সহজ পাচ্য, মিষ্টি ও হাল্কা গরম হবে।
শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে যে বাড়তি খাবারগুলো দিতে হবে:
শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুর স্বাস্থ ভালো রাখতে খাদ্য তালিকায় পরিপূরক খাদ্য হিসাবে যে সমস্ত পুষ্টিকর ও সুষম খাবার যুক্ত করতে হবে সেগুলো হলোঃ
❖ আলু ও ডাল সিদ্ধ করে চটকিয়ে খাওয়াতে হবে।
❖ বিভিন্ন প্রকার শাক-সব্জি, চাল, ডাল মিশিয়ে নরম খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানো যেতে পারে।
❖ ডাল বা দুধে রুটি ভিজিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।
❖ বিভিন্ন প্রকার দেশীয় ফল যেমন কলা, পেঁপে, কাঁঠাল, পেয়ারা, আম, আনারস ইত্যাদি চটকিয়ে বা এসব ফলের জুস বানিয়েও খাওয়ানো যেতে পারে।
❖ ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুকে পারিবারিক পদ্ধতিতে দুধ দিয়ে তৈরি পায়েস বা সুজি রান্না করে খাওয়ানো যেতে পারে।
❖ মুরগির ডিম সিদ্ধ ও নরম করে খাওয়ানো যেতে পারে।
❖ চিড়া, মুড়ি বা ভাত, দুধ দিয়ে নরম করে মেখে খাওয়ানো যেতে পারে।
❖ টমেটো, মটরশুটি, ফুলকপি, শিম ও অন্যান্য শাকসব্জি ভাল করে সিদ্ধ করে চটকিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।
❖ শাকসবজির সাথে রান্না করা মাছ ভালো করে চটকিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
❖ স্বাস্থ ভালো রাখার পাশাপাশি শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি এবং মানসিক বিকাশের জন্য অবশ্যই খাবারের সাথে আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়াতে হবে।
শিশুকে পরিপূরক খাবার দেয়ার ক্ষেত্রে যে যে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে:
শিশুকে নতুন খাবার দেওয়ার সময় কিছু বিশেষ দিকসমুহের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে, যেমন তাঁর স্বাস্থ, শারীরিক অবস্থা, বয়স, ওজন ইত্যাদি। বাচ্চারা অসুস্থ থাকা শারীরিক জটিলতার জন্য অনেক সময় খেতে চায়না। তাই তাঁর স্বাস্থ ভালো আছে কিনা বা তাঁর শরীরে কোন প্রকার অসুখ-বিসুখ বা জটিলতা রয়েছে কিনা এজন্য একজন অভিজ্ঞ শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান ও সুস্থভাবে বেড়ে উঠার জন্য শিশুর অভিবাবকদের আরও যে বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে সেগুলো হলো-
❖ ছোট শিশুরা একবারে বেশি করে খেতে পারে না। একবারে বেশি করে খেতে দিলে উল্টো বাচ্চার স্বাস্থের অবনতি ঘটতে পারে। তাই বাচ্চাকে অল্প করে বারবার ও বিভিন্ন ধরনের খাবার দিতে হবে।
❖ শিশুর খাবার অবশ্যই প্রয়োজনীয় ক্যালরী সমৃদ্ধ হতে হবে।
❖ শিশুর খাবার বয়স অনুযায়ী আমিষ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ ঠিকমতো আছে কিনা তা নির্ধারন করে নিতে হবে।
❖ শিশুর খাবারগুলো সহজপাচ্য, পুষ্টিমান ও সহজলভ্য হতে হবে।
❖ শিশুকে সাধারণতঃ বাবা মায়ের সংগে বসিয়ে খাওয়াতে হবে যাতে সে খাবারে উৎসাহ পায়।
❖ শিশুকে খাবারের জন্য কোন প্রকার জবরদস্তি করা যাবেনা। কারণ ক্ষুধা পেলে সে আপনা আপনিই খাবে।
❖ লক্ষ্য রাখতে হবে যেন শিশুর প্রতিদিনের খাবার একই ধরনের না হয় ।
❖ শিশুর খাবার অবশ্যই বিশুদ্ধ ও নিরাপদ হতে হবে।
সময়মত পরিপূরক খাবার না দিলে যে সমস্যাগুলো হতে পারে
সময়মত পরিপূরক খাবার না দিলে শিশু পুষ্টিহীণতায় ভুগতে পারে ও তাঁর স্বাস্থের অবনতি ঘটতে পারে। এর ফলে তাঁর পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর প্রভাব যেমন অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন প্রকার উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
শিশুকে যদি বেশি দেরী করে বাড়তি ও উপযুক্ত খাবার না দেওয়া হয় তাহলে তাঁর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
ছোট শিশুরা আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ। তারাই দেশ ও সমাজের ভবিষ্যত কর্ণধার । তাই জীবনের শুরুতেই যদি সঠিক ও পুষ্টিকর খাবার না পায় তাহলে তাঁর স্বাস্থের অবনতি সহ সুস্থভাবে বেড়ে উঠা মারাত্বক ভাবে ব্যাহত হতে পারে। তাই প্রতিটি শিশু যাতে সুস্থ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে বেড়ে উঠে সে দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।