• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯
মাতামুহুরী এখন মরণ ফাঁদ

ছবি : সংগৃহীত

সারা দেশ

মাতামুহুরী এখন মরণ ফাঁদ

  • কক্সবাজার প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ৩১ মে ২০১৯

বর্ষা এলেই কক্সবাজারের চকরিয়ার মাতামুহুরী নদী ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। তার ওপর নদীর বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন চলায় মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে এ নদী। গত এক বছরে শিক্ষার্থীসহ ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে এ নদীতে। সর্বশেষ গত রোববার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের মাঝেরফাঁড়ি সেতু পয়েন্টে মাতামুহুরী নদীতে গোসল করতে নেমে আমজাদ হোসেন (৮) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়।

জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী চকরিয়ার মাতামুহুরী। ভারী বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর দুপাড়ে বসবাসরত মানুষের জীবন বিপৎসংকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছু বালিখেকো প্রভাবশালী মহল বালুমহালে পরিণত করেছে মাতামুহুরী চরকে। প্রতিনিয়ত মাতামুহুরী নদীতে শক্তিশালী ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে অসংখ্য স্থানে তৈরি হচ্ছে গভীর গর্তসহ চোরাবালি। মানবসৃষ্ট এই চোরাবালির কারণে নদীতে গোসল করতে নেমে সলিল সমাধি হচ্ছে মানুষের। বিশেষ করে দুরন্তপনা শিশু-কিশোররা এই বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে বেশি।

একসময়ের নিরাপদ মাতামুহুরীর এমন রূপের জন্য নদীর বিভিন্ন স্থানে মানবসৃষ্ট চোরাবালিকেই দায়ী করছেন সচেতন মহল। গত দুই মাসে নদীর চকরিয়া অংশের বিভিন্ন ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি পয়েন্টে শক্তিশালী ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করায় সেখানে নতুন করে তৈরি হচ্ছে চোরাবালি। কিন্তু বরাবরের মতোই প্রশাসনের কর্মকর্তারা রয়েছেন একেবারেই নির্বিকার। প্রশাসন সবকিছুই অবগত থাকলেও রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপে তারাও অনেকটা অসহায় বলে অভিযোগ উঠেছে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রভাবশালীরা মাতামুহুরী নদীর পূর্ব কাকারা পয়েন্টে শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে। এতে ওই পয়েন্টের একাধিক স্থানে গভীর গর্ত হয়ে চোরাবালির সৃষ্টি হয়।

গত বছরের ১৪ জুলাই মাতামুহুরী নদীর চিরিঙ্গা সেতুর কাছের বালুরচরে ফুটবল খেলার পর গোসল করতে নদীতে নামে চকরিয়া গ্রামার স্কুলের একদল স্কুল শিক্ষার্থী। তার মধ্যে চোরাবালিতে তলিয়ে গিয়ে প্রাণ হারায় পাঁচ শিক্ষার্থী। একসঙ্গে পাঁচ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় পুরো কক্সবাজারে নেমে আসে শোকের ছায়া। দাবি ওঠে, নদীতে তলিয়ে যাওয়ার পয়েন্টে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের। পরবর্তীতে সেই ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। ওই সময় চকরিয়া ফায়ার সার্ভিসের প্রধান জিএম মহিউদ্দিন শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চোরাবালি সৃষ্টির জন্য দায়ী করেছিলেন।

জানা যায়, গত দুই মাসে মাতামুহুরী নদীর চকরিয়ার ঘুনিয়া, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, পৌরসভার বিভিন্ন পয়েন্ট, সাহারবিলের রামপুর, মাইজঘোনা, কৈয়ারবিল, বাঘগুজারা, বেতুয়া বাজার, কোনাখালীর কন্যারকুম, চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগরঘোনা, চরণদ্বীপসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্টে চলে প্রভাবশালী বালুদস্যুদের অপতৎপরতা। এতে নদীতে সৃষ্টি হয় ২০-৩০ ফুট গর্তসহ অসংখ্য চোরাবালি। বালুদস্যুদের এমন তৎপরতা এখনো চলছে। চকরিয়া কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত ওসমান জানান, এর আগেও মাতামুহুরী নদীর বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্ট চোরাবালিতে পড়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছে এই এলাকার অনেকেই। মাতামুহুরী নদীর তিন কিলোমিটারে ড্রেজিয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএস ন্যাশনের কর্ণধার নূরে বশির বলেন, ‘যেখানে শ্যালো মেশিন বা ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়, সেখানে নির্দিষ্ট জায়গায় বড় ধরনের একটি গর্তের সৃষ্টি হয়। আর সেই গর্ত ভরাট হয় পলিমাটিতে। তখন সেই গর্তের মধ্যে কেউ ঢুকে গেলে সহজে বের হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাদের নদীর তিন কিলোমিটারে ড্রেজিং করার জন্য নিয়োজিত করেছে। সেই মোতাবেক ডিজাইন ও তিনটি কাটার ড্রেজার মেশিন পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিয়ের মাধ্যমে নদীর তলদেশ থেকে বালু অপসারণ করছেন। নদীর অন্যান্য পয়েন্টে যেসব শ্যালো মেশিন ও ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে, তাতে আমার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।’

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা বলেন, ‘শক্তিশালী ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে নদীর বুকে বিভিন্ন স্থানে বড় ধরনের গর্ত তৈরি হয়ে চোরাবালিতে পরিণত হচ্ছে। এতে আগামী বর্ষা মৌসুমে নদীর তীর ভেঙে বহু স্থাপনা বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার বলেন, মাতামুহুরী নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। যারা এই অপকর্ম করে নদীতে চোরাবালি সৃষ্টি করছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads