বর্ষা মৌসুম আগত। এ সময় পাহাড়ধসের শঙ্কা বহুগুণে বেড়ে যায়। দুই বছর আগে ১৩ জুনে প্রবল বর্ষণে পাহাড়ধসে রাঙামাটিতে ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন দুই শতাধিক মানুষ। তিন মাস আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছিলেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। পরের বছর একই সময়ে রাঙামাটির নানিয়ারচরে প্রবল বর্ষণে মৃত্যু হয় ১১ জনের। বারবার এত হতাহতের পরও থেমে নেই পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস।
এরই মধ্যে জেলা প্রশাসন বলেছে, শহরের ৩১টি জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ। জেলায় তিন হাজার ৩৭৮ পরিবারের প্রায় ১৫ হাজার লোক পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। তবে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও তাদের সরানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রাণহানি এড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
রাঙামাটিতে স্মরণকালের পাহাড়ধসের ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির পরও বর্ষা শেষে ফের একই স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে ঘরবাড়ি। রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী, যুব উন্নয়ন এলাকা, মনতলা আদাম, সাপছড়ি, পোস্ট অফিস এলাকা, মুসলিমপাড়া, নতুনপাড়া, শিমুলতলী, মোনঘর ও সনাতনপাড়ায় গত বছর সবচেয়ে বেশি পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এরপরও সেসব এলাকায় বসত স্থাপন থেমে থাকেনি।
মুসলিমপাড়া এলাকার ইসমাইল ও রমিজা বেগম পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত একই জায়গায় আবার নতুন বসতি গড়ে তুলে সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। তারা জানান, অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই মৃত্যুর শঙ্কা আছে জেনেও নিজেদের ভিটামাটি ছাড়বেন না তারা। যদি সরকার তাদের নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করে দেয়, সেক্ষেত্রে চলে যাবেন।
ওই পরিবারের একজন বলেন, ‘সরকার আমাদের জায়গা ছাড়তে বলে; কিন্তু আমরা কোথায় যাব, কোথায় থাকব, সেই বিষয়ে কিছুই বলেনি। তাই আমরা কোথাও যাব না। বাঁচলে এখানেই বাঁচব, মরলে এখানেই মরব।’
যুব উন্নয়ন ও মনতলা আদাম এলাকার বাসিন্দা রবীন্দ্র লাল চাকমা ও সোনা চন্দ্র চাকমা জানান, বর্ষা মৌসুমে জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চিহ্ন দিয়ে চলে যায়। পাহাড়কে ঝুঁকিমুক্ত করে বসবাসের উপযোগী করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশীদ বলেন, ‘পাহাড়ধস মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বছর ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অতিমাত্রায় বৃষ্টির ফলে পাহাড়ধস হলেও যাতে প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে আমরা সতর্ক। শহরের ৩১টি জায়গাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’ পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পাহাড়ধস বন্ধে সুপারিশ কাগজেই : পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০১৭ সালের জুন মাসে ভয়াবহ পাহাড়ধসের পর একাধিক মন্ত্রণালয় কয়েকটি কমিটি করেছিল। এর কারণ অনুসন্ধানে এসব কমিটি কাজ করে। পাহাড়ধস বন্ধে কমিটিগুলোর প্রতিবেদনে অনেক সুপারিশও আসে। তবে দুই বছর পর দেখা যাচ্ছে, এসব সুপারিশ কাগজেই রয়ে গেছে।
পাহাড়ধস বন্ধে সুপারিশগুলো যে বাস্তবায়িত হয়নি, তা স্বীকারও করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং। তিনি বলেন, ‘সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নের দায় শুধু আমাদের নয়, এটা আন্তঃমন্ত্রণালয় উদ্যোগের বিষয়। সেই সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’
অন্যদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেন, ‘আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। তবে সুপারিশগুলো শুধু যদি কাগজেই সব থেকে যায়, তবে তা দুঃখজনক।’
২০১৭ সালের ১২ থেকে ১৩ জুন পার্বত্য তিন জেলাসহ ছয় জেলায় পাহাড়ধসে ১৬৮ জন নিহত হন। ১৩ জুন পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে নিহত হন ১২০ জন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে পাহাড়ধসে এত প্রাণহানি আগে হয়নি।