• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সারা দেশ

বিয়ে করতে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন রোহিঙ্গা তরুণীরা

  • প্রকাশিত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

মাহাবুবুর রহমান, কক্সবাজার

বাংলাদেশে বিয়ে করতে দেড়-দুই লাখ টাকা দরকার। কিন্তু এত টাকা পাব কোথায়। মা নেই, বাবা নেই। মালয়েশিয়ায় পরিচিত অনেকে আছেন। ভেবেছিলাম, ওখানে গিয়ে তাদের কাউকে বিয়ে করে ফেলব। কাজ নয়, বিয়ে করতেই মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম। ট্রলারডুবি থেকে বেঁচে ফেরা রোহিঙ্গা নারী ইছমত আরা এমনটাই বলেন।

টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ট্রলারে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছিলেন শামিমা। তিনিও জানালেন মালয়েশিয়ায় পরিচিত এক আত্মীয় বলেছে সে আমাকে বিয়ে করবে। তাই সেখানে যাচ্ছিলাম, আমার মতো অনেকে বিয়ে করতেই মালয়েশিয়া যাচ্ছিল বলে জানান তারা। কিন্তু সেন্টমার্টিনের ছেঁড়াদ্বীপের কাছে পৌঁছলে তাদের ট্রলারটি ডুবে যায়।

কক্সবাজারের টেকনাফে কাছে বঙ্গোপসাগরে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে ট্রলারডুবির ওই ঘটনায় অন্তত ১৫ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। সাগর থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ৭১ জন। এখনো নিখোঁজ অন্তত ৫২ জন। তাদের উদ্ধারে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড।  উদ্ধার ও নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। যাদের সিংহভাগই তরুণী।

উদ্ধার হওয়া টেকনাফের শামলাপুর ক্যাম্পের তরুণী খতিজা বেগম বলেন, বাবা নেই, তাই যৌতুক দিয়ে বিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ অন্ধকার চিন্তায় জীবনটা এলোমেলো চলছে। পরিচিতদের মাধ্যমে জেনেছি, মালয়েশিয়ায় স্থানীয় ও প্রবাসীরা বিনা যৌতুকে তরুণীদের সম্মান দিয়ে বউ করে নেন। তাই সংসারী হতেই ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় হয়নি।

একই কথা বলেন, মধুরছড়া ক্যাম্প থেকে ট্রলারে ওঠা রোকসানা বেগম, জাদিমুরার হোসনে আরা, লম্বাশিয়ার ইয়াসমিন। তারা বলেন, ক্যাম্পে জীবনটা বিষিয়ে উঠেছে। স্বজাতিরাই অসহনীয় আচরণ করেন। এখানে সময়টা অতিবাহিত হলেও বুড়িয়ে যেতে হচ্ছে। তাই পরিচ্ছন্ন ভবিষ্যতের সন্ধানে আমরা ঝুঁকি নিয়েছি।

উদ্ধার হওয়া এসব রোহিঙ্গা তরুণীর সঙ্গে রয়েছেন কিছু বিধবা ও স্বামী-পরিত্যক্তাও। তাদের মধ্যে নূর বানু ও ছলেমা খাতুন বলেন, কোনো একটা কাজে যোগ দিয়ে সন্তান ও নিজেদের সামনের দিনগুলো সুন্দর করার আশায় আমরা ট্রলারে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে চেষ্টা করেছিলাম। এভাবে মাঝ সাগরে ট্রলার ডুবে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে কল্পনাও করিনি।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি এমন তথ্য দেন। তিনি বলেন, উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা ভেঙে যাওয়া নিজেদের স্বপ্নের কথা বলার পাশাপাশি আরো জানান, অর্থলোভী পাচারচক্র ইচ্ছা করেই অমানবিকভাবে সাগরের মাঝপথে ট্রলারটি ফুটো করে ডুবিয়ে দিয়েছেন-এমন ধারণা তাদের। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে মৃতের সংখ্যা কম হয়েছে, জানান উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা। ডুবে যাওয়া ট্রলারে ১২০ থেকে ১২৫ নারী-পুরুষ ও শিশু ছিল।

জানা গেছে, প্রশাসনিক কড়াকড়িতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে সাগরপথে মালয়েশিয়া মানব পাচার চক্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে গত সোমবার রাতে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলারটি ডুবে যায়।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুর রব জানান, উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বলেছেন, মালয়েশিয়া যেতে জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের রাতের আঁধারে ট্রলারে তুলে দেয় দালালচক্র। অন্তত বিয়ে করে নিরাপদ জীবনের আশায় মালয়েশিয়া যেতে ঝুঁকি নেন তারা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, ঘটনাটি মর্মান্তিক। কঠোর নজরদারি থাকায় গত বছর আদম পাচারকারী চক্র অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যেতে ট্রলার ভেড়াতে পারেনি। মহেশখালী, কক্সবাজার সদরের ইসলামপুর, নাজিরারটেক, মেরিন ড্রাইভের বাহারছরা, সোনাদিয়াসহ আরো কয়েকটি স্থানে মালয়েশিয়া নেওয়ার উদ্দেশে জড়ো করা কয়েক শ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। এরপর দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সোমবার চক্রটি রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলার সাগরে নামায়।

উদ্ধার হওয়াদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দালালদের শনাক্তে কাজ করছে পুলিশ। এত মৃত্যুর পরও রোহিঙ্গারা প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা না মানলে এমন মর্মান্তিকতা রোধ করা অসম্ভব। তাই মানব পাচার নিয়ে কাজ করা জিও-এনজিও ও জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়ানো দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সাগরে ট্রলারডুবির ঘটনায় নিখোঁজদের উদ্ধারে বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার, নৌবাহিনী ডুবুরি ও কোস্টগার্ডের প্রশিক্ষিত টিমের সদস্যরা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads