• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
মরতে বসেছে মাতামুহুরী নদী

প্রতিনিধির পাঠানো ছবি

সারা দেশ

মরতে বসেছে মাতামুহুরী নদী

  • মো. সাইফুল ইসলাম খোকন, চকরিয়া (কক্সবাজার)
  • প্রকাশিত ২২ মার্চ ২০২১

এক কালের খরস্রোতা প্রমত্ত মাতামুহুরী নদী নাব্যসঙ্কটে পড়েছে। এখন নদীর বুকে জেগে উঠেছে চর। মাইলের পর মাইল বালুর চর আর চর। নদীর বুকে চর জেগে উঠায় এখন নাব্য হ্রাস পেয়েছে। এ অঞ্চলের ভূস্বর্গখ্যাত মাতামুহুরী নদীর চিরাচরিত স্বভাব পুরোটাই পাল্টে গেছে কালের পরিক্রমায়। মাতামুহুরী নদীকে ঘিরে চকরিয়াবাসীর অভিশাপ আশীর্বাদ দুটোই জড়িত। বর্ষায় যেমন এ নদী অগ্নিরূপ ধারণ করে, তেমনি শুকনো  মৌসুমে নদীর প্রকৃতি রূপলাবণ্যে ভরে ওঠে। আবার বর্ষা মৌসুমে নদী দিয়ে প্রবাহিত বন্যায় দুকূল উপচে গিয়ে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। বানের পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন তীব্রতর হয়। তখন আতঙ্কে থাকে নদী তীরের মানুষ তাদের ঘরবাড়ি সহায়সম্পত্তি নিয়ে। তবে এসময় তারা আশায় বুক বাঁধে শুকনো মৌসুমের অপেক্ষায়। নদী তীরের কৃষক চাষী ব্যস্ত থাকে কৃষি উৎপাদন করে বর্ষায় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, দেশের দক্ষিণপূর্ব সীমান্তের ওপারে বার্মার আরাকান রাজ্যের বিশাল পাহাড়, পর্বতমালা থেকে মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি, যা বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার পাহাড়ি এলাকা কুরুপপাতা ও পোয়া মুহুরী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। পরে চারটি উপজেলা আলীকদম, লামা, চকরিয়া ও পেকুয়ার মাটি ভেদ করে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিরামহীন চলার পথে আলীকদমের ইন্দু, সিন্দু, চকরিয়ার বাইস্যার ছড়া পর্যন্ত ১১৩টি ছোট বড় খাল ও ছড়া নদীতে মিশে গিয়ে মাতামুহুরীকে করে তোলে চির প্রাণযৌবন। আর এ নদীর তীরকে ঘিরে এ অঞ্চলে গড়ে উঠে প্রচীন সমাজ-সভ্যতা। তৎসময়ে লামা-আলীকদমের সঙ্গে চকরিয়ার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম ছিল মাতামুহুরী নদীপথ। এককালে এই মাতামুহুরী নদীতে ভেসে চলতো বড় আকারের নৌকা ও সাম্পান। মানুষ একদিন একরাত নৌকায় চড়ে পরবাস খেটে লামা-আলীকদমে পৌঁছত। তখন নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মাতামুহুরীর তীরে গড়ে উঠেছিল সাপ্তাহিক হাট-বাজার। মানুষজন ও ব্যবসায়ীরা নৌকায় করে সওদা নিয়ে এক স্থান হতে অন্য স্থানে যাতায়াত করত।

স্থানীয়রা জানান, এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে মাতামুহুরী নদীর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এ নদীর পানি যেমন কৃষকের ফসলে শক্তি যোগায়, তেমনি নানা প্রজাতির মাছ ধরে জেলেদের জীবন জীবিকার সহায়ক হতো। এখন সে নদী জেলেশূন্য। সবই যেন এখন স্মৃতি।

মৎস্য কর্মকর্তাদের মতে, মাতামুহুরী নদীর দু-তীরে দীর্ঘ দুদশকের ক্ষতিকর তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছের ওপর। তামাক ক্ষেতে অতিমাত্রায় ইউরিয়া সার ও নানা ধরনের কীটনাশক ছিটানো হয়। এসব কীটনাশক পানির সঙ্গে মিশে নদীতে পড়ে। এতে নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে এবং ছোট ছোট মাছগুলো মরে যাচ্ছে।

স্থানীয়দের মতে, তামাক চাষের ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াও মাতামুহুরীতে মৎস্য সম্পদের বিলুপ্তি ঘটছে একশ্রেণির লোভী মৎস্য শিকারি ও উপজেলা মৎস্য অফিসের দায়িত্বহীনতার কারণে। মৎস্য বিভাগের দায়িত্ব অবহেলার কারণে জেলেরা নদীতে বিষ দিয়ে মাছ আহরণ করে। এতে নদীতে মাছ মরে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে বিষের কারণে চিংড়ি মাছ মারা পড়ে বেশি। এছাড়াও নদীর যেখানে একটু গভীরতা আছে সেখানেই জেলেরা জঙ্গল কেটে ঘের তৈরি করে। কিছুদিন পর ঘেরের চারপাশে বিষ দিয়ে একশ্রেণির পাহাড়ি গাছের ফলের রস ছিটিয়ে মাছ আহরণ করা হয়। প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়েও এ নদীতে মাছ শিকার করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবের সমন্বয়কারী ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, আগের মাতামুহুরী নদী এখনকার নদীর মধ্যে অনেক পার্থক্য। যেভাবে নদীর নব্য হ্র্রাস পেয়েছে তা ফিরে আনতে হবে। মাতামুহুরী নদীর মাছ রক্ষা ও সাগরকেন্দ্রিক এ নদীর প্রাণ ও মাছ- দুটি বাচাঁনো প্রয়োজন।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী এলাকায় তামাক চাষ বন্ধ ও তামাক চাষের পরিবর্ত বিকল্প চাষাবাদের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নদীতে বিষপ্রয়োগসহ বিভিন্ন উপায়ে মাছ নিধনের কারণে মৎস্য ভান্ডারের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads