• বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪২৯
বুড়িমারীতে গুজব ছড়িয়ে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনায় ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

সংগৃহীত ছবি

সারা দেশ

বুড়িমারীতে গুজব ছড়িয়ে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনায় ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

  • লালমনিরহাট প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০২ এপ্রিল ২০২১

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি দিয়ে আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েলকে হত্যার পর লাশ পোড়ানোর ঘটনায় হাফিজুল ইসলাম নামে এক ইউপি সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

আজ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে বুড়িমারী বাজার থেকে ওই ইউপি সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ড সদস্য। ওই ঘটনায় দায়ের তিনটি মামলায় এখন পর্যন্ত পুলিশের হাতে ৪৮ জন গ্রেপ্তার ও ১২ জন স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন।

গত ২৯ অক্টোবর বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক সাহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রীপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক ছাত্র ছিলেন। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।

জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওসি ওমর ফারুক বলেন, সাহিদুন্নবী জুয়েল হত্যায় দায়ের করা হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনে হামলার মামলায় এজাহার নামীয় আসামি ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলাম দীর্ঘ দিন পলাতক ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে বুড়িমারী বাজার থেকে হাফিজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

জুয়েল হত্যার ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলায় পুলিশ এখন পর্যন্ত ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়াও স্বেচ্ছায় আদালতে আত্নসমার্পন করেছেন ১২ জন আসামি। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ১৬জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। যার মধ্যে মূলহোতা বুড়িমারী ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল হোসেন ওরফে হোসেন ডেকোরেটর এবং মসজিদের খাদেম জোবেদ আলীসহ ছয় জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই মামলায় গ্রেফতারদের মধ্যে হত্যা মামলায় মুয়াজ্জিন ও অন্য দুই মামলায় মোট ১৮জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বলেও নিশ্চিত করেন তিনি।

উল্লেখ্য, গত ২৯ অক্টোবর সাহিদুন্নবী জুয়েল বিকেলে সুলতান রুবায়াত সুমন নামে এক জনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন শরীফ ও হাদিসের বই তার পায়ের ওপর পড়ে যায়। সে সময় কোরআন শরীফ ও হাদিসের বই তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান রুবায়াত সুমনকে পাশে ইউপি ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান।

সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। সে সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউপি ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে-হেঁচড়ে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।

সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট-পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন্ত কুমার মোহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর ও পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুলতান রুবায়াত সুমনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।

ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত ৩০ অক্টোবর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা বলে জানায় পুলিশ।

এ ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার কোনো সত্যতা পায়নি। গুজব ছড়িয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা ও পরে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন দুটি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads