• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯
কফিনে বন্দি প্রবাসীদের ‘হাজারো স্বপ্ন’

প্রতিনিধির পাঠানো ছবি

সারা দেশ

কফিনে বন্দি প্রবাসীদের ‘হাজারো স্বপ্ন’

  • মো. এমদাদ উল্যাহ, চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা)
  • প্রকাশিত ১১ এপ্রিল ২০২১

তাহের মিয়া(৩৬)। স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েসহ পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষনের জন্য সৌদি আরব পাড়ি জমিয়েছিলেন। আশা ছিল, ভরণ-পোষণের পর অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে পরিবারের সদস্যদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস গত ১৮ মার্চ বৃহস্পতিবার সৌদি আরবের জেদ্দায় এলাকায় ভবন নির্মাণ কাজ করা অবস্থায় তিনি মারা যার। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ায় তাহের মিয়ার স্ত্রী ও সন্তানসহ আত্মীয় স্বজনের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। এক কথায়-স্ত্রী সন্তানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। নিহত তাহের মিয়া কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামের ইসলাম মিয়া ও ছমুদা বেগমের ছোট ছেলে। ২২ দিন পর ৯ এপ্রিল শুক্রবার বিকেলে তাঁর ‘কফিন বন্দি’ লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। 

নিহতের ভাতিজা মো. ফরিদুজ্জামান বলেন, প্রবাসে যাওয়ার পর পরিবারের ভরণ-পোষণসহ আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর রাখতে তাহের মিয়া। তিনি সকলের প্রতি আন্তরিকতার সাথে কাজ করতেন। ১৮ মার্চ হঠাৎ সৌদিআরবে বিল্ডিং কনষ্ট্রাকশনের কাজ করা অবস্থায় তার মৃত্যুর খবর কেউ মেনে নিতে পারেনি। দুর্ঘটনার পর তাহের মিয়ার পাসপোর্ট পুলিশের হাতে থাকায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করতে নানা হয়রানীর সম্মুখীন হতে হয়েছে। এক্ষেত্রে বেশি সহযোগিতা করেছেন ফুফা মোস্তফা কামাল, ভাই শরিফুল ইসলাম, মামা আজিমুর রহমান ও বাংলাদেশে ভিপি সাহাব উদ্দিন। দুর্ঘটনার পর ২২ দিনের প্রচেষ্টায় অবশেষে ৯ এপ্রিল শুক্রবার তাহের মিয়ার লাশ দেশে আনা হয়। ওইদিন বিকেলে স্থানীয় মাঠে নামাজে জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। নামাজে জানাযায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্নস্থান থেকে আগত বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসল্লী, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ।

এখন কি করবে প্রবাসী তাহের মিয়ার স্ত্রী ও তিন সন্তান? কে দিবে তাদের ভরণ-পোষণের অর্থ, কে নিবে সন্তানদের পড়ালেখার খোঁজ? এভাবে প্রবাসী তাহের মিয়ার মতো হাজার হাজার প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। এর মধ্যে বৈধ উপায়ে যাওয়া প্রবাসীদের পরিবার নিহত প্রবাসীর লাশ খুঁজে পায়। অবৈধ উপায়ে যারা প্রবাসে যায় অনেক ক্ষেত্রে তাদের লাশ পাওয়া গেলেও সঠিক ঠিকানা না থাকায় বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করা হয়। অনেকের পরিবার-তাদের সন্তান জীবিত কি মৃত সেই খবরও পায় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উন্নত জীবনের আশায় প্রতিদিন হাজার হাজার যুবক পাড়ি জমাচ্ছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এদের কেউ কেউ ভিটা-বাড়ি বন্ধক দিয়ে উচ্চমূল্যে ভিসা নিয়ে, সুদে টাকা নিয়ে প্রবাসে পাড়ি দিচ্ছেন। অনেকেই আবার টাকার বিনিময়ে চুক্তি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন সমুদ্রপথে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রতি পরিবারেই প্রবাসী রয়েছে। এরমধ্যে সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, জর্ডান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, রোমানিয়াসহ ১৬৮টি দেশে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী প্রবাসী কাজ করে। এই প্রবাসীরা রাত-দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করছেন শুধু পরিবারের সুখ আর শান্তির জন্য। কাজের ব্যস্ততার কারণে খেয়ালই থাকে না কোন ফাঁকে যে নিজের জীবনের সুন্দর রঙিন দিনগুলো চলে গেল। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে বাংলাদেশীদের ভিসা জটিলতা, কাজের ক্ষেত্রে নতুন নতুন নিয়ম চালু করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এ রকম প্রতিকূল পরিবেশে থেকে নিজের কষ্টটুকু বুঝতে দেয় না পরিবারকে। দুই ঈদ ও বিভিন্ন উৎসবে যেমন সবাই আনন্দ করে, প্রবাসীর ঈদের দিনেও কাজে যেতে হয়। কর্মস্থলে সহপাঠীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দটুকু ভাগাভাগি করেন নিজেদের মতো করে। আবার বেশিরভাগ দেশেই নিজ দেশের কারণে বেতন, আকামাসহ নানা ধরনের ঝামেলার মধ্যে দিন কাটে প্রবাসীর। মাস শেষে যখনই বেতন হাতে পায় সেই বেতনের টাকা কখন দেশে পরিবারে কাছে পাঠাবে সেই চিন্তায় অস্থির থাকে। আবার অনেক সময় দেখা যায় কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো বেতন পায় না। বেতন দিতে দেরি হলে দেশ থেকে ফোন আসে মাস তো শেষ- টাকা পাঠাও। পাড়ার দোকানে ও পাওনাদাররা তাড়া দিচ্ছে।

কিন্তু যে প্রবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করে অর্জিত অর্থ দেশে পাঠান, তাদের অনেকেই দেশে ফিরে স্বজনদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হন। ওই অর্থ যাদের কাছে পাঠানো হয়, তারা নানা কারণে টাকা খরচ করে ফেলেন। আবার অনেক প্রবাসীর পাঠানো অর্থে গড়া সম্পদ শেষ পর্যন্ত অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়।

প্রবাসীদের অধিকার, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব শ্রম কল্যাণ উইংয়ের। বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা গেলেও তাদের সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষায় ২৬টি দেশের বাংলাদেশ মিশনে শ্রম কল্যাণ উইং আছে মাত্র ২৯টি। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদিআরব এবং ইতালিতে দুটি করে শ্রম কল্যাণ উইং আছে। কর্মীদের যথার্থ সেবা, সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিত করতে আরও শ্রম কল্যাণ উইং প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিদ্যমান উইংগুলোর জনবলও বাড়ানোর প্রয়োজন বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

কোনো প্রবাসী বিদেশে মারা গেলে বাংলাদেশ সরকার লাশ দাফনের জন্য ৩৫ হাজার টাকা এবং পরে তিন লাখ টাকা প্রদান করে। কিন্তু কেউ একজন বিদেশে মারা গেলে একটি লাশ কিভাবে দেশে আসে সেই খোঁজ কেউ রাখে না। পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন গুঞ্জন করে লাশের সঙ্গে কত টাকা আসছে? শুধু মা-বাবা ছাড়া প্রায় সবার মনে এ কৌতূহল জাগে কত টাকা এসেছে কফিনের সঙ্গে। লাশ আসার আগে পাওনাদাররা এসে বসে থাকে টাকার জন্য। বেশিরভাগ শ্রমিক কম বেতনে কাজ করে যা পায় তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালায়। সংগঠন বা বন্ধু-বান্ধব মিলে প্রবাসীদের কাজ থেকে টাকা তোলে যে যা পারে সহযোগিতা করে।

এমনও অনেক প্রবাসীর মরদেহ হিমঘরের বাক্সে পড়ে থাকে যার খোঁজ-খবর নেয়ার কেউ নেই। দেখা যায়, এদের মধ্যে বেশিরভাগ নকল পাসপোর্ট বা অবৈধপথে আসা প্রবাসী। অনেক সময় বাংলাদেশের নাগরিক ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, অন্যদেশে পাসপোর্ট নিয়ে প্রবেশ করেন। তথ্যে গরমিল থাকার কারণে খোঁজ না পেলে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন দেয়া হয়।

দূতাবাসের তথ্যমতে, বেশিরভাগ প্রবাসী স্ট্রোক করে মারা গেছে। সাধারণ প্রবাসীরা যখন ধারদেনা শোধ ও পরিবারের কথা চিন্তা করে অতিরিক্ত পরিশ্রম করে একটু বেশি টাকা পেতে নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখে না, একটা সময় সে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বেডে ছটফট করে। পরিবারে সুখের ও শান্তির জন্য আসা প্রবাসী যখন অসুস্থ হয়ে দেশে যায় কিছুদিন পর টাকার অভাবে সেই প্রবাসী ও তার পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করে। আগে যেই পরিবার দশ জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলত এখন শরমে আত্মীয়স্বজন কারও কাছে বলতে পারে না। তাই বিদেশে প্রত্যেক প্রবাসীর উচিত আগে নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখা। মনের প্রশান্তির জন্য কাজের ফাঁকে ছুটির দিনগুলোতে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মিলিত হলে দুঃখ-কষ্ট কমে, মানসিক চাপ ও অশান্তি কমে যায়।

প্রবাসী তার পরিবারের শান্তি ও সুন্দরের জন্য পরিশ্রম করে নিজের জীবন শেষ করেন। প্রবাস জীবনে কখন ঈদ আসে কখন বিদায় নেয় এই খোঁজ রাখার সময় কোথায়? বাড়ি থেকে ফোন আসে ঈদের জন্য একটু বেশি টাকা পাঠাও।

এদিকে দেশে আসা প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে পাঁচটি পরামর্শ দিয়েছে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি ‘প্রত্যাশা’ ও ‘অনুপ্রেরণা-২’ প্রকল্প। এগুলো হলো, ফিরে আসা প্রবাসী ও তাঁদের পরিবারের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ না করে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি নিরূপণ করে মনঃসামাজিক সহায়তাসহ টেকসই পুনরেকত্রীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে সহজ শর্তে বিভিন্ন ধরনের ঋণ সুবিধা, গন্তব্য দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো বন্ধ করা এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাঁরা যেন কাজে ফিরতে পারেন, সেই উদ্যোগ নেওয়া।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ‘প্রত্যাশা’র ফিল্ড অর্গানাইজার জসিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রবাসীদের সেবা দিতে সারাদেশেই ব্র্যাকের কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া সম্ভাব্য অভিবাসী, প্রবাসী কর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যসহ যে কেউ অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য জানতে বিনা খরচে ০৮০০০১০২০৩০ নম্বরে এবং বিদেশ থেকেও +৯৬১০১০২০৩০ নম্বরে ফোন করে অভিবাসন সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য সেবা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ফোন করে সরাসরি তথ্যসেবা পাওয়া যাবে। এ সময়ের বাইরে ফোন করলে সে ফোন কলটির রেকর্ড থেকে পরবর্তীতে কলদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে’। তিনি আরও বলেন, নিজের জীবন এবং পরিবারের কথা চিন্তা করে প্রত্যেক সম্ভাব্য অভিবাসীর উচিত-দক্ষ হয়ে বৈধ উপায়ে প্রবাসে যাওয়া। এতে করে সরকারীভাবে এবং বেসরকারিভাবে নানাবিধ সমস্যার সহজ সমাধান পাওয়া যায়।।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads