মৌসুমি লিচু ফল বিক্রির জন্য কেউ কাঁধে, কেই বাই সাইকেলে, আবার কেউ রিকশায় ভ্যান গাড়ি করে নিয়ে বাজারে আসছেন। প্রস্তুত রয়েছে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্রেতারাও। ক্রেতা বিক্রেতাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে এলাকা। এমন দৃশ্য দেখা যায়, ব্রাহ্মবাড়িয়ার আখাউড়া ও বিজয়নগরের আওলিয়া বাজার এলাকায়। প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টায় এই ৩ ঘন্টায় চলে লিচু কেনা বেচা। এ ৩ ঘণ্টায় অন্তত ১৫-২০ লাখ টাকার উপর লিচু বেচা-কেনা হয় বলে স্থানীয় চাষিরা জানায়।
এছাড়াও মেরাশানী, মুকুন্দপুর, কাংকইরা বাজার, চম্পকনগর, সিঙ্গারবিল বাজার, আমতলী বাজারসহ আরো কয়েকটি বাজারে পাইকারীভাবে লিচু বেচা-কেনা হয়।
সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় জেলাসহ দেশেরে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে লিচু কিনে বিভিন্ন যানবাহন দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতি ও আবহাওয়া কিছুটা প্রতিকূল থাকার পরেও এই দুই উপজেলায় এ বছর লিচুর ফলন ভালো হয়েছে বলে কৃষকরা জানায়। গত এক সপ্তাহের উপরে চলছে লিচু বেচা-কেনা ।
বিকিকিনিতে যোগ দিচ্ছেন স্থানীয় চাষি, ব্যবসায়ী ও পাইকাররা। তবে এখানকার লিচু রসালো,মিষ্টি ও স্বাধে অুুলনীয় হওয়ায় জেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তওে এর কদর ও রয়েছে বেশ ভাল।
বর্তমানে লিচুর ভরা মৌসুম হওয়ায় এই দুই উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের অন্তত অর্ধশতাধিকের উপর গ্রামের নারী পুরুষ সবাই লিচু নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এ বছর করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বিজয়নগরে লিচুর ভালো ফলন হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন চাষীরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় ৫১০ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিজয়নগর উপজেলায় ৩৭৫ হেক্টর, আখাউড়ায় ৯০ হেক্টর রয়েছে।
সরেজমিনে এদিকে আখাউড়া উপজেলার আজমপুর, রামধননগর, চানপুর, দুর্গাপুর, খারকোট, মিনারকোট, নিলাখাত, বিজয়নগরের পাহাড়পুর, সেজামুড়া, কামালমুড়া, গিলামুড়া, জলিলপুর, মুকুন্দপুর,চানপুর,ভিটিদাউদপুর,খাটিংগা, বিষ্ণুপুর, ছতুরপুর, কালাছড়া, বক্তারমুড়া, শ্রীপুর, নোয়াগাও, পত্তন, আদমপুর, সিঙ্গারবিল, চম্পকনগর এলাকায় প্রায় চার শতাধিকের উপর লিচুর বাগান রয়েছে। এসব বাগানে দেশী লিচু, এলাচি লিচু, চায়না লিচু, পাটনাই লিচু ও বোম্বাই লিচু চাষ করা হয়। বর্তমানে লিচু নিয়ে চাষিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বাগানে বাগানে চলছে লিচু সংগ্রহের কাজ। গাছ থেকে পেড়ে বাজারজাত করতে মহিলাসহ সব বয়সের লোকজন কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ দিন মজুর হিসাবেও কাজ করছেন।
এসব এলাকার এমন কোন বাড়ি নেই যার আঙ্গিনায় ৪-৮টি লিচু গাছ নেই। গাছে গাছে লাল লিচুতে রঙ্গিন হয়ে আছে পুরো এলাকা। গ্রাম জুড়ে এখন গাছ ভর্তি লিচু আর লিচু । থোকায় থোকায় বাহারি লিচুতে যেন সবার মন কাড়ছে। সেই সাথে লিচুর মৌ মৌ গন্ধ আর ছোট পাখিদের কিচির মিচির শব্দে এলাকা এখন মুখরিত হয়ে উঠেছে।
বাজারে লিচুর ভাল দাম পাওয়ায় কৃষকদের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। এসব এলাকায় বানিজ্যিক ভাবে লিচু চাষে অর্থনীতি উন্নয়নে যতেষ্ট ভূমিকা রাখছে।
লিচু নিয়ে গড়ে উঠেছে বিজয়নগরের আওলিয়া বাজার, হরেষপুর, মুকুন্দপুর, মিরাশানি, আখাউড়ার আজমপুরসহ বেশ কয়েকটি পাইকারী ও খুচরা বাজার। ওইসব বাজারে প্রতিদিন অন্ত:ত ১৫-২০ লাখ টাকার লিচু বিক্রি হয়।
এদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল থাকায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন এসব বাজার থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নরসিংদী, ভৈরব, নোয়াখালী, চাদপুর, মৌলভীবাজার, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ, ফেনী ও রাজধানী ঢাকার ব্যবসায়ীরা লিচু কিনে বিভিন্ন যানবাহনে করে নিয়ে যায়।
বাজারে লিচুর ভাল দাম পাওয়ায় কৃষকদের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। এসব এলাকায় বানিজ্যিক ভাবে লিচু চাষে অর্থনীতি উন্নয়নে যতেষ্ট ভূমিকা রাখছে।
বিজয়নগর এলাকার লিচু চাষি মো. আব্বাস মিয়া বলেন, বাড়ি সংলগ্ন অন্যান্য ফল গাছের পাশাপাশি তার প্রায় ৪৫ টি লিচু গাছ রয়েছে। নানা প্রতিকুলতার মধ্যে প্রত্যেকটি গাছে লিচু ভালো এসেছে। স্থানীয় বাজারে গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে বেচাকেনা। এ পযর্ন্ত তিনি ২৭ হাজার টাকার লিচু বিক্রি করেছেন বলে জানায়। তিনি আরো বলেন নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে আরো অন্ত:ত ৩০ হজার টাকার লিচু বিক্রি হবে।
লিচু চাষি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ২টি বাগানে দেশীয়,চাইনা বোম্বে জাতের ৫৫ টি লিচু গাছ রয়েছে। অন্য বছরের চাইতে এ মৌসুমে ফলন কিছুটা কম হলে ও বাজারে বিক্রিতে ভালো দাম পাচ্ছেন। তিনি আশা করছেন ১লাখ টাকার উপর লিচু বিক্রি হবে।
বিজয়নগরের চাষি মো নাজমুল আলম, তার ১টি বাগানে ৪০টি লিচু গাছ রয়েছে। তবে এ মৌসুমে অতিরিক্ত গরম বৃষ্টিসহ নানা কারণে কিছু ক্ষতি হলে ও ফলন ভালই হয়েছে। বাগান থেকে লিচু তোলার শেষ সময় পর্যন্ত প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগ না হলে আর্থিক ভাবে অনেক লাবভান হবে বলে জানায় অনেক চাষি।
লিচু চাষী আক্তার হোসেন বলেন, ৬০ শতাংশ জমিতে আমার লিচুর বাগান। এবার বোম্বাই জাতের লিচু চাষ করেছি। আগে মৌসুমের শুরুতে বাগান বিক্রি করে দিতাম। কিন্তু এবার বিক্রি করিনি। আশা করছি খরচ মিটিয়ে লাখ টাকার লিচু বিক্রি করতে পারব।
মো. আজগর আলী বলেন, ১ বাগানে ৪৫ টি লিচু গাছ রয়েছে। এ পযর্ন্ত ১৩ হাজার টাকার উপর লিচু বিক্রি করেন বলে জানায়।
দুলাল মিয়া বলেন, ৮৫ টি গাছ অন্য বছরের চাইতে লিচু তুলনামুলক ভাল হয়েছে। আশা করছি কোন দুর্যোগ না ঘটলে লাখ টাকার উপর বিক্রি করা হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাইকার মো. সিরাজ মিয়া ও রুবেল মিয়া বলেন, মৌসুমি ফল লিচু এখান থেকে ক্রয় করে দীর্ঘ ৮-১০ বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে তারা বিক্রি করছেন । এখানকার লিচু মিষ্টি ও রসালো হওয়ায় বিক্রিতে ভালো লাভ হয় বলেন জানায়। তিনি প্রতিদিন গড়ে ৩০-৪০ হাজার টাকার লিচু কিনে বাজারে বিক্রি করেন বলে জানায়।
মাধবপুরের পাইকার মো. হুমায়ুন মিয়া বলেন,দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এখানকার লিচু কিনে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করছি। এখানকার লিচু রসালো ও মিষ্টি হওয়ায় বিক্রিতেও লাভ হয় বেশী।
কুমিল্লা জেলা থেকে লিচু কিনতে আসা ব্যবসায়ী জাকির হোসেন জানান, বাজারে বিজয়নগরের লিচুর বিশেষ চাহিদা থাকায় আমি প্রতি বছরই এখান থেকে লিচু কিনে কুমিল্লায় নিয়ে পাইকারী বিক্রি করি। এখানকার লিচু মিষ্টি ও সু-স্বাদু হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে এর চাহিদা বেশি। তিনি বলেন, এখান থেকে প্রতি একশ লিচু পাইকারী ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় কিনে কুমিল্লায় নিয়ে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা দরে বিক্রি করি।
আখাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা বেগম বলেন, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় আবহাওয়ার কারণে লিচুর কিছু ক্ষতি হলে ও শেষ পযর্ন্ত তুলনামুলক ভাবে ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে চাষিরা বিক্রিতে ভালো দাম পাচ্ছেন। ফলন ভালো রাখতে সার্বিক ভাবে চাষিদেরকে পরামর্শ দেওয়া হয় বলে জানায়।
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর,ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপ-পরিচালক মোঃ রবিউল হক মজুমদার বলেন, লিচুর ভালো ফলনের জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বাগান মালিকদের সব ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এবছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকার উপর লিচু বিক্রি হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করছেন।