• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯
‘ইটালি’তে নেই নাগরিক সুবিধা

ইটালির একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের বর্তমান দৃশ্য

ছবি: বাংলাদেশের খবর

সারা দেশ

‘ইটালি’তে নেই নাগরিক সুবিধা

  • দেলোয়ার কবীর, ঝিনাইদহ
  • প্রকাশিত ১৮ জুলাই ২০২১

জেলার শৈলকুপা উপজেলা শহর থেকে ৯ কিলেমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গ্রামটির নাম ‘ইটালি’। গ্রামের নাম উচ্চারণ করলেই উপজেলার বাইরের যে কেউ চমকে উঠেন, নামটি আবার জানতে চান আসলে এটি ইউরোপীয় দেশ ইটালি কি-না। হ্যাঁ, আসলেই এটির নাম ‘ইটালি’। তবে দেশের বাইরের নয়, খোদ বাংলাদেশের একটি গ্রাম, যেখানে সব সাধারণ মানুষ বসবাস করেন। উপজেলার দিগনগর ইউনিয়নের এ গ্রামটির পশ্চিমে আগুনিয়াপাড়া, উত্তরে সিদ্দি, দক্ষিণে দেবতলা ও পূর্বে শৈলকুপা পৌরসভার হাসনাভিটা গ্রামের অবস্থান। গ্রামটির দৈর্ঘ্য আড়াই কিলোমিটারের মতো, জনসংখ্যা ১২শ ৩ জন, যার ৬শ জনই নারী। প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষিতের এ গ্রামটিতে ঘরেঘরে লেখাপড়া জানা ও বেশ কিছু গুণীজন থাকলেও একবিংশ শতাব্দীর এযুগে গ্রামটিতে বিদ্যুতের আলো পৌঁছেছে ঠিক, কিন্তু সড়ক যোগাযোগ মান্ধাতা আমলের। ফলে বৃষ্টি-বাদলার দিনে এখনো ওই গ্রামের লোক অনেকটাই গৃহবন্দি দিনযাপন করেন। প্রয়োজনীয় কালভার্ট না থাকায় বৃষ্টির পানি মাঠ থেকে বেরুতে পারেনা, বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকে আর ফসলহানি ফি বছরের। গ্রামে ঢোকা বা বের হবার ছোটবড় ছয়টি সড়ক থাকলেও কোনোটিই শেষ হয়ে হয়নি আজতক। শৈলকুপা থেকে ‘ইটালি’ যাবার জন্য প্রস্তাবিত পাকা সড়কের ভবিষ্যতও গ্রামের কেউ জানে না।

গ্রামের নামকরণ বিষয়ে জানতে সরেজমিনে ইটালি গেলে ঘিরে ধরেন গ্রামবাসী। তাদের ধারণা, সাংবাদিক গ্রামে গেলে, লেখালেখি করলেই হয়ত তাদের সব সমস্যার সমাধান হবে শিগগির। খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই বয়স্কসহ ৫০-৬০ জনের মতো লোক জড়ো হয়ে যায়। ৯১ বছরের রিয়াজউদ্দিন মন্ডল, ৮৩ বছরের জোয়াদ আলি, ৮২ বছরের বসির উদ্দিন ও ৬৮ বছরের খয়বার হোসেনসহ উপস্থিত গ্রামবাসী জানালেন, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের গ্রামের মানুষের অবদানের কথা। তাদের মতে, একটু বৃষ্টি কাঁদা হলে গরু-মোষের গাড়ি ছাড়া যানবাহন চলতে পারে না, তেমন কোনো সড়কও নেই। উপজেলা শহর থেকে হরিদেবপুর-অচিন্ত্যপুর ঘুরে ‘ইটালি’ গ্রামের শুরুতে পৌঁছানো গেলেও শেষ সীমানা পর্যন্ত আর ঢোকা যায় না। প্রশস্ত কাঁচা সড়কও নেই। শুকনো মৌসুমেও সরু সড়কে রিকশাভ্যান ভরসা সবশ্রেণির মানুষের।

ইটালির নামকরণ বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রামের কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি। বয়োজ্যেষ্ঠরা জানান, তাদের বাপ-দাদার কাছে শুনেছেন, গ্রামটিতে আগে নমসুদ্র শ্রেণির মানুষ বাস করতেন, যাদের মূলপেশা ছিল মাটির জিনিসপত্র তৈরি বা কুমারের কাজ। ওসব জিনিষপত্র পোড়ানোর জন্য তারা বড় বড় ঢিপির চুলা তৈরি করত এমনসব প্রমাণ মেলে। প্রায় জনমানবশূন্য গ্রামে বাইরের গ্রাম থেকে কৃষকরা এসে চাষাবাদ করত। চাষাবাদের লাঙল চালালেই মাটির বড়বড় চাঙড় বা ঢিলা (ঢিল) বের হতো যা ইটের চেয়েও বেশি শক্ত বলে তাদের মনে হতো। ফলে তখনকার মানুষ এ গ্রামের নাম ইটের সাথে সম্পর্কিত ‘ইটেলি’ আখ্যায়িত করেন, যা পরবর্তীতে ‘ইটালি’ নামে পরিগণিত হয়। দুশ বছরের কাগজ-কলমেও স্বনামের মৌজায় গ্রামের নাম ‘ইটালি’ লেখা রয়েছে।

গ্রামবাসী জানান, শুধুমাত্র সড়ক যোগাযোগের অভাবে অন্য সম্প্রদায়ের কোনো মানুষ সেখানে বসতি গড়েনি। এখনো বাইরের অনেকে এ গ্রামে যাওয়া বা আত্মীয়তার বন্ধন ঘটানো সম্মানজনক মনে করেন না। চুলদাঁড়ি কাটা, কাপড়-চোপড় ধোয়া, জুতো সেলাই করা, অনুষ্ঠানের বাজনা-বাজানো বাদক দল বা ওই জাতীয় কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের কেউ এখনো বসবাস শুরু না করায় সেসব কাজ সারতে গ্রামবাসীকে ছুটতে হয় দূরে, বিষয়টি গল্পের মতো মনে হলেও সত্যি।

মাহবুব আলম নামে একজন ব্যাংকার জানালেন, তার গ্রামে কোনো খেলার মাঠও নেই যা ছেলে-মেয়েদের শরিরচর্চা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবে। সড়ক সংযোগ না থাকায় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ওই গ্রামের ছেলে-মেয়েরা অনেকটাই পিছিয়ে আছে। তারা যেটুকু করছে তা শুধু আত্মিক মনোবল, অভিভাবক, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায়।

দিগনগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সাব্দার হোসেন ঝন্টু জানালেন, তাদের মতো কপাল পোড়া মানুষের গ্রাম ‘ইটালি’র উন্নয়নের বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন সভায় বছরের পর বছর আলোচনা হয়, উন্নতি বলে কোনো কিছু তাদের নজরে আসেনি। ফলে গ্রামের লোকের কাছে তার মতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেক সময় গালমন্দ শুনতে হয়, অসম্মানিত হতে হয় যা খুব লজ্জার।

ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান তপন জানান, তার ইউনিয়নে ছয়টি সড়কের কাজ চলমান। ইটালি-শৈলকুপার নির্মাণাধীন সড়কের আর মাত্র ১৪শ মিটার নির্মাণ করা গেলেই গ্রামটির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads