• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯
রামু সহিংসতার নয় বছর, এখনো শেষ হয়নি বিচারপ্রক্রিয়া

সংগৃহীত ছবি

সারা দেশ

রামু সহিংসতার নয় বছর, এখনো শেষ হয়নি বিচারপ্রক্রিয়া

  • কক্সবাজার প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

রামু সহিংসতার আজ নয় বছর। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামু, ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে ১৯ বৌদ্ধ বিহার, ৪১ বসতঘর পুড়িয়ে দেয় দূর্বৃত্তরা। ভাংচুর ও লুটপাট করা হয় আরো ৬টি বৌদ্ধ বিহার সহ অর্ধশত বৌদ্ধ বসতঘরে। এতে কয়েক শত বছরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পুড়ে যায়। ঘটনার পরপরই পোড়া মন্দিরে তৈরী হয়েছে নান্দনিক স্থাপনা।

এ ঘটনার পর মামলা দায়ের করা হলেও নারকীয় হামলার বিচারপ্রক্রিয়া নয় বছরেও শেষ হয়নি। সাক্ষীর অভাবে এ বিচার প্রক্রিয়া থমকে আছে বলে জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পি. পি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম। রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে হামলার ঘটনায় সর্বমোট ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়। তৎমধ্যে বাদীর সম্মতিতে ১টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। অন্য ১৮টি মামলা আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সাক্ষীর সহযোগীতায় বিচারকার্য তরান্বিত হবে।

তিনি জানান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সবরকম পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।

ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধদের আক্ষেপ ও অভিযোগ হলো মামলার আসামি, সাক্ষীর সাক্ষ্য দেয়া নিয়ে। বৌদ্ধরা মনে করেন, মামলার আসামি এবং মামলার সাক্ষী হিসেবে যাদের নাম দেয়া হয়ে ছিলো, তাদের নাম যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এখন যাদের নাম সাক্ষীর তালিকায় আছে, তাদের অনেকেই জানে না সাক্ষীর তালিকায় তাদের নাম রয়েছে।

নয় বছরে বৌদ্ধদের মাঝে ফিরেছে সম্প্রীতি। দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাশৈলীতে পূণ্যার্থীদের পাশাপাশি বেড়েছে পর্যটক আকর্ষণ। ক্ষতিগ্রস্তরা পেয়েছেন নতুন ঘর। এখনও বিভিন্ন বিহারগুলোতে নিরাপত্তায় সতর্ক রয়েছে পুলিশ বাহিনী। সেনাবাহিনী সহ স্থানীয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারী রেখেছে সকল বৌদ্ধ বিহারে। পুজাপার্বন, ধর্মীয় উৎসবে অন্যধর্মালম্বীর সরব উপস্থিতে মুখরিত হয় এখন বিহার প্রাঙ্গন। সম্প্রীতিতে ফিরতে পারায় খুশি বৌদ্ধরা। তবে বিচারপ্রক্রিয়ার অচলাবস্থা নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে রয়েছে এখনও অসন্তোষ। অপরাধীরা আইনের আওতায় না আসায় তাদের শংকা কাটছেনা।

রামুতে বুদ্ধমুর্তি, বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ বসতিতে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলার সেই বিভীষিকাময় দিনকে স্মরণে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ দিনব্যাপী কর্মসূচী পালন করছে। রামুতে লাল চিং বিহারে প্রথম অগ্নিসংযোগ করে দূর্বৃত্তরা। আজ ২৯ সেপ্টেম্বর বুধবার ‘লাল চিং ও মৈত্রী বিহার’ প্রাঙ্গণের এ স্মরণ অনুষ্ঠানে প্রধান ধর্মদেশক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিনবোধি মহাথের। রামু পানের ছড়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ সুচারিতা মহাথের এ অনুষ্ঠানের সভাপতি করবেন।

ভোরে বুদ্ধপূজা, সকালে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্ট পরিষ্কার দানসহ মহাসংঘদান, দুপুরে শান্তিপুর্ণ মানববন্ধন, অতিথি ভোজন, বিকালে হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সন্ধ্যায় বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনার মাধ্যমে রামু সহিংসতার নয় বছর স্মরণানুষ্ঠানে মানবতা ও শান্তি কামনা করা হবে বলে জানান, রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের আহ্বায়ক বিপুল বড়ুয়া আব্বু। অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ স্থানীয় বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা অংশ নিবেন বলে জানান সদস্য সচিব বিপ্লব বড়ুয়া।

রামু সহিংসতার সেই কালো রাতের ঘটনা স্মরণ করে রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের পরিচালক শীলপ্রিয় থের বলেন, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আমাদের বৌদ্ধ বিহারগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। সেই সম্পদ ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। সেই সময়ে কিছু দুর্বৃত্তের একটি রাত ছিলো। ঘটনাটি স্মরণ করলে এখনও চোখ দিয়ে জল বাহির হয়ে যায়। কঠিন সময় গেছে আমাদের। দূর্বৃত্তরা আমাদের বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ পল্লী পুড়িয়ে দিয়ে অনেক ক্ষতি করেছে। তিনি বলেন, আমরা হারিয়ে যাওয়া দিনের চেয়ে, বর্তমানে অনেক সম্প্রীতি ভোগ করছি। এখন আমাদের সম্প্রীতি অনেক বৃদ্ধি হয়েছে। আমরা রামুবাসিরা সম্প্রীতিতে আছি। আগামী দিনেও আমাদের এ সম্প্রীতি ধরে রাখতে হবে।

শীলপ্রিয় থের বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তড়িৎ সিদ্ধান্তে ওই সময়ে আমাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পুণঃনির্মাণ করে দেয়া হয় বৌদ্ধ বিহারগুলো। এ জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, ঘটনার পরে তাড়াহুড়োর মধ্যে ভবনগুলো নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে পরিকল্পনা বা তদারকির মধ্যে অনেক ঘাটতি ছিলো। নয় বছরে মধ্যেই সেই নান্দনিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি হলেই রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। ভবনগুলো জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন।

জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুর ১২ বৌদ্ধ বিহার, ৩০টি বসতঘর, পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া ও টেকনাফে ৭টি বৌদ্ধ বিহার, ১১টি বসতঘর পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। পুড়ে যায় এসব মন্দিরে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক সব নিদর্শন। লুটপাট ও ভাংচুর করা হয় আরো ৬টি বৌদ্ধ বিহার, অর্ধশত বৌদ্ধ বসতঘরে। এ ঘটনার পর দায়ের করা হয় ১৯টি মামলা। এর মধ্যে রামুর আটটি মামলায় ৪৫৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে রামু থানায় জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দু’পক্ষের আপস মীমাংসার ভিত্তিতে প্রত্যাহার করা হয়।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পি. পি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানান, সাক্ষীর সহযোগিতার অভাবে বিচারকার্য ত্বরান্বিত করা যাচ্ছে না। সাক্ষীরা যদি যথাযথ সাক্ষ্যদান করেন, তাহলে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করা যাবে এবং ঘটনার সত্য উদঘাটন হবে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রকৌপ ও পুরো কক্সবাজার জেলায় পুলিশ বাহিনীতে বদলিজনিত কারণে মামলার স্বাক্ষীগ্রহণে বিঘ্নতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, দু’বছরে করোনার সময়ে মামলার অগ্রগতি থমকে আছে। তবে মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। করোনার আগেই আদালতের মাধ্যমে সাক্ষী হাজির করার তাগাদা দেয়া হয়। পুলিশ যদি মামলার স্বাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন এবং স্বাক্ষীরা যদি যথাযথ সাক্ষ্যদান করেন তাহলে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করা যাবে এবং ঘটনার সত্য উদঘাটন হবে।

কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, রামুতে ১৮টি মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে কিছুই বৌদ্ধ সম্প্রদায় জানে না। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পুলিশকে বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাংচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে এদের অনেকেরই নাম পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। রামু সহিংসতার মতো আর কোন ঘটনা যাতে বাংলাদেশে আর না ঘটে সেটার একটা দৃষ্টান্ত রচিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি জড়িতদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে সুপারিশ করে। কিন্তু ঘটনার পরিকল্পনাকারী গডফাদারদের কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে আটক করে এসব মামলা দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। আবার অনেক সাক্ষীর নাম-ঠিকানাও লেখা হয় ভুলভাবে। তাই আটক সবাই পেয়ে গেছে জামিন। দায়ীরা রয়েছে এখনও অধরা। সচেতন মহলের মতে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের ন্যাক্কারজনক এ ঘটনার পরিকল্পনাকারী, গডফাদার বা নেতৃত্বদাতাদের মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেই বেরিয়ে আসবে ঘটনার আসল রহস্য।

রামু একশফুট ভূবণ শান্তি গৌতম বুদ্ধমূর্তি’র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালক করুণাশ্রী থের বলেন, মধু পূর্ণিমার রাতে রামু, উখিয়ার প্রায় ২০টি বৌদ্ধ বিহার পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয় আমাদের ‘একশ ফুট বিশ্ব শান্তি গৌতম বুদ্ধ মূর্তি’ ও ‘বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে’। এটি শুধু দুঃখ-কষ্ট, ক্ষতি নয়। আন্তর্জাতিক ভাবে সমাদৃত বাংলাদেশের বহু পত্নতাত্ত্বিক নির্দশন পুড়িয়ে দেয়া হয়। সংস্কৃতি সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক এ নিদর্শন গুলো দেশবিদেশের যোগাযোগের সেতু বন্ধন ছিলো। শুধু বৌদ্ধদের জন্য নয়, রামুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমৃদ্ধ বৌদ্ধ বিহার গুলো বাংলাদেশের গর্ব ছিলো।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads