• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯
শ্রম বিক্রির হাটে ক্রেতা নেই

ছবি: বাংলাদেশের খবর

সারা দেশ

শ্রম বিক্রির হাটে ক্রেতা নেই

  • রফিকুল ইসলাম রফিক, রংপুর
  • প্রকাশিত ১১ অক্টোবর ২০২১

সকাল সাড়ে আটটা। রংপুর মহানগরীর শাপলা চত্বরে তখনো অর্ধশত শ্রমজীবী মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। কেউ ডালি-কোদাল, কেউ ব্যাগ, কেউবা করাত ও খুনতি পাশুন নিয়ে। রাস্তার চারপাশ থেকে কেউ সাইকেলে, কেউ অটো রিকশায়, কেউ পায়ে হেঁটে এসেছেন সেখানে। সকাল দশটা বাজতে প্রায় দুই-শ শ্রমিক হয়ে গেল। তখনো কোনো শ্রম কেনার ক্রেতা আসেনি শাপলা চত্বরে। সবার নজর কেউ এসে বলবে-অ্যাই কাজে যাবে নাকি?  কিন্তু সকাল দশটা পেরিয়ে ১১টা বাজলেও শ্রম কেনার ক্রেতা আসেনি। ফলে শ্রম বিক্রি না করেই সবাইকে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। গতকাল রোববার এই চিত্র দেখা যায় শাপলা চত্বরে।

এটা শাপলা চত্বরে প্রতিদিনের দৃশ্য। এখানে রংপুর সদর ছাড়াও পার্শবর্তী এলাকার অনেকেই আসেন কাজের জন্য। এটাকে শ্রমিক বেচাকেনার হাট বলে থাকেন শ্রমিকরা।

রংপুরের গুড়াতি পাড়ার আশিকুর রহমান জানান, ‘হামরা এটেকোনা দৈনিক আসি। আগের মতন কাজ নাই। গত পাঁচ দিন কোনো কাজ পাইনাই। আইজ একজন আসি ডাকি নিয়ে গেইচে বালু তুলতে কিন্তু কয় দুই-শ টাকা দিন হাজরে, করি নাই ফেরত আসলোং। বাজারোত সোগ জিনসের দাম বেশী। দুই-শ টাকা দিয়ে কী হইবে’।

রংপুরের বাহার কাছনা তকেয়ার পাড় এলাকার আব্দুল নুর জানান, ‘এখন ধান কাটা শুরু হয় নাই, আলুও নাই। গ্রামোত কোন কাজ নাই। বসি থাকপের নাগে। এটিকোনা কাজের জন্য আসি দৈনিক, এক সপ্তাহ থাকি কোনো কাজ নাই। কাইও কাজোত ডাকে না। ছুরুমিক ( শ্রমিক) মেলা, কাজ নাই’।

কাউনিয়ার হারাগাছের এনামুল হক জানান, ‘হামরা আসি কাজের জন্যে। যাদের লোক প্রয়োজন তারা আসি ডাকে নিয়ে যায়। কাইও ৩৮০ টাকা দেয়, কাইও কমও দেয়। দৈনিক কাজ হয় না’।

পানবাড়ী এলাকার রেজাউল করিম বলেন, ‘সকাল ৮ টায় আসি ১২ টায় যাই। কাজ হইল হইল না হইল না। কাজ হইলে নিয়ে যায় না হইলে নাই।  এলা ডাল সিজেন। কাজ নাই। খালি জিনসের দাম বাড়ে, হামার দাম তো বাড়ে না। কাজও নাই খাই কী?’

শ্রমিকরা জানিয়েছেন, এখানে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই-শ শ্রমিক আসে। যার শ্রমিক প্রয়োজন তারা এসে দাম দর করে নিয়ে যায়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল আটটা থেকে বেলা সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত কোনো শ্রমিক কাজে যায়নি। কেউ কাজের জন্য শ্রমিক নিতেও আসেনি।

রংপুর কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে সাড়ে ৫ লাখের ওপর শুধু মৌসুমি শ্রমিক রয়েছে। এসব শ্রমিক শহরে রিকশা, ভ্যান অথবা অন্য কোনো পেশা গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এসব মৌসুমি শ্রমিক ধানের মৌসুমে শুধু নিজ জেলার বাইরে অন্য জেলায় গিয়ে কাটা মাড়াই করে বাড়তি আয় করেন।

অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন,  রংপুর বিভাগের আটটি জেলাকেই শিল্পে অনুন্নত জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২০১৬ সালে। এছাড়াও শিল্পনীতিতে শিল্পায়নে পশ্চাৎপদ এবং অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর এলাকায় সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়নে সুপারিশমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য জানুয়ারি, ২০১৭ থেকে ডিসেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে। কিন্তু তার উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

শুধু কৃষির ওপর নির্ভরতার কারণেই কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এ কারণে শ্রমিক এবং দরিদ্রতার হার বাড়ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আয় ও ব্যয় খানা জরিপ বলছে, ২০১০ সালে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ, ছয় বছর পর ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ। এরমধ্যে রংপুর জেলাতেই ৪৪ শতাংশ।

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোরশেদ হোসেন জানান, রংপুর বিভাগের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। যুগ যুগ ধরে শিল্প খাত রয়ে গেছে অনুন্নত। রংপুর বিভাগ শিল্পায়নে অন্য অঞ্চলের চেয়ে পিছিয়ে আছে, এজন্য এখানে শিল্পায়নের পরিমাণ বাড়াতে হবে। যে সকল এলাকায় বেশি শিল্পায়ন হয়েছে সেখান থেকে কম শিল্পায়ন এলাকায় শিল্প পুনর্বণ্টন ও স্থানান্তর করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্প হচ্ছে শ্রমঘন শিল্প, রংপুর বিভাগের সস্তা শ্রম এক্ষেত্রে সহায়ক। এ অঞ্চলে গার্মেন্টস শিল্প স্থাপন করা হলে এখানকার দরিদ্র জনসাধারণের আয় ও জীবনযাত্রার মান বাড়বে।

রংপুরে চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী টিটু জানান, রংপুর অঞ্চলে শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত বেকার সংখ্যার হারটা অনেক বেশি। বেকারত্ব দূর করতে গেলে কৃষি শিল্পের বাইরে ভারী, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প কারখানা তৈরি করতে হবে।

তিনি বলেন, নর্থবেঙ্গলের জন্য ৫ বছর বা দশ বছর মেয়াদি একটি পলিসি নিতে হবে। যেটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে। নর্থ বেঙ্গলকে এগিয়ে নিতে গেলে অবশ্যই নর্থবেঙ্গল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দরকার। তাহলে এই অঞ্চলের মানুষের বেকারত্ব এবং সামাজিক বৈষম্য দূর হবে, বেকারত্ব কমে যাবে, ইনকাম কমে বেড়ে যাবে। এজন্য শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই।

  

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads