• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
প্লাস্টিকে ডুবছে মৃৎ শিল্প

ছবি: বাংলাদেশের খবর

সারা দেশ

এখনও স্বপ্ন দেখছেন জড়িতরা

প্লাস্টিকে ডুবছে মৃৎ শিল্প

  • আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৬ জানুয়ারি ২০২২

কেউ তৈরি করছেন মাটির পুতুল, ঘোড়া, গরু, হাতি, ময়ূর, খেলনা, কেউ বা তৈরী করছেন হাড়ি, পাতিল, খোড়া, থালা মাছসহ বিভিন্ন প্রকার সামগ্রী। পাশাপাশি রং তুলি দিয়ে ওইসব সামগ্রীগুলাতে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় করে তুলছেন। তৈরিসহ হাট বাজার ও পাড়ায় মহল্লায় বিক্রিতে নারী পুরুষ সবাই যেন ব্যস্ত সময় পার করছেন। এমন দৃশ্য দেখা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের দরুইন গ্রামে। এই গ্রামে দীর্ঘ বছর ধরে অন্ত:ত ১৫-২০টি পরিবার মাটি দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্লাস্টিক সামগ্রীর কাছে এ মৃৎ শিল্পের কদর দিন দিন কমে গেলে ও জড়িতরা তাদের কর্মদক্ষতার দ্বারা এই শিল্পটাকে আকড়ে ধরে এখনও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে এগিয়ে চলছেন।

এ শিল্পের সাথে জড়িতরা জানায়, মেলাকে ঘিরে ছিল তাদের জমজমাট ব্যবসা। বর্তমান পরিস্থিতি ও প্লাস্টিক সামগ্রির কাছে দিন দিন এ শিল্পের কদর অনেকটাই যেন কমে যাচ্ছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে মেলা না বসলেও বসে নেই মাটির তৈরী বিভিন্ন প্রকার সামগ্রী বিক্রি। বাড়িতে তৈরী করা ওইসব সামগ্রী প্রতিদিন তারা ভ্যাগ গাড়ি করে হাটে বাজারে পাড়া মহল্লায় বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

তবে বর্তমানে দুঃখ-কষ্টের মাঝে তাদের দিন কাটলেও এখনও তারা স্বপ্ন দেখেন কোনো একদিন কদর বাড়বে মাটির পণ্যের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আখাউড়া পৌর শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে দরুইন গ্রাম অবস্থিত। সেখানেই প্রায় ১৫-২০ পরিবার জীবন ও জীবিকার তাগিদে এ শিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। বাড়ির উঠানে কিংবা পাশে ফাঁকা জায়গায় বসে মাটি দিয়ে পুতুল, ঘোড়া, গরু, হাতি, ময়ূর, খেলনা, কেউ বা তৈরী করছেন হাড়ি, পাতিল, খোড়া, থালা মাছসহ বিভিন্ন প্রকার সামগ্রী তৈরি করছেন।

একাধিক বাসিন্দা জানান, সকাল থেকে শুরু হয় ওইসব জিনিস তৈরীর কাজ। এরপর রোদে শুকানো ও রং তুলির সাহয্যে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। নারী পুরুষরা সমান তালে একাজ করেন। সাধ্যমতো সহযোগিতা করে ছেলে-মেয়েরাও।

এ শিল্পের সাথে জড়িত একাধিক কারিগররা জানায়, মাটির তৈরীর জিনিসপত্রের সঙ্গে গ্রামের সৌখিন মানুষদের নাড়ির সম্পর্ক তৈরী হয়ে আছে। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে মৃৎ শিল্পের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের জায়গা দখল করেছে স্বল্প দামের প্লাস্টিক ও লোহার তৈরি পণ্য। এজন্য গ্রাম গঞ্জে হাটে বাজারে মাটির তৈরির বিভিন্ন প্রকারের সামগ্রীর চাহিদা কম থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এশিল্পটি। বছরের পর বছর ধরে এই মানুষগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না।

দরুইন গ্রামের মৃৎ শিল্পী কালুপাল (৬০) বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে বাপ দাদার এই ব্যবসা আকড়ে ধরে বেঁচে আছি। বৈশাখ আর জৈষ্ঠ্য মাসকে ঘিরে আমরা সব সময় অপেক্ষায় থাকতাম। এই দুই মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক মেলা বসতো। ওইসব মেলায় মাটির তৈরির বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রায় লক্ষাধিক টাকার বিক্রি হতো। মাটি ক্রয় মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাদে অর্ধ লক্ষ টাকার উপর আয় হতো। কিন্ত বর্তমান পরিস্থিতিতে মেলা না বসায় তাদের অনেকটাই বিপাকে পড়তে হয়। তাই এখন ওইসব জিনিসপত্র হাট বাজার ও গ্রামে গঞ্জে বিক্রি করা হয়। দৈনিক ১২শ থেকে ১৫শ টাকা বিক্রি হয় বলে জানায়। সরকারের সহযোগিতা পেলে এশিল্পটাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

রাখাল দাস বলেন, তার ঘরে অন্ত:ত এক লাখ টাকার মাটির তৈরির জিনিস প্রস্তত রয়েছে। মেলা না থাকায় বিক্রি করতে পারছেন না। তাই তিনি হাটে বাজারে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছেন। দৈনিক ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা বিক্রি হয় বলে জানায়। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে জীবন বাঁচাতে এ ভাবেই ওইসব জিনিস তৈরী ও বিক্রি করছেন ।

পলাশ দাস বলেন, বাপ দাদার পেশা তাই ছাড়তে পারছি না। নানা প্রতিকুলতা অপেক্ষা করে বছরের পর বছর আকড়ে ধরে আছি। এখন বাজারে বিভিন্ন প্রকার প্লাস্টিকের সামগ্রী রয়েছে। এতে করে আমাদের এই হাতের তৈরি জিনিসগুলো কদর কমে গেছে। অনেকেই পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাটির জিনিসপত্র তার পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। ফলে এ পেশায় যারা জড়িত এবং যাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন মৃৎ শিল্প তাদের জীবন যাপন একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন এ শিল্পটা ছিল মেলা কেন্দ্রীক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মেলা না বসায় জীবিকা অর্জন খুবই কষ্ট কর হয়ে উঠছে। অন্য পেশার কাজ না শিখায় তাই বাধ্য হয়ে আকড়ে ধরে আছেন। তৈরীকৃত মালামালগুলো প্রতিদিন হাট বাজারে গ্রামে গঞ্জে ভ্যান গাড়ি নিয়ে বিক্রি করছেন বলে জানায়। এতে ভালো সারা পাচ্ছেন বলে জানায়।

ঝর্ণা রানী পাল জানান, এখানে প্রায় ২০টি মৃৎ শিল্পের পরিবার রয়েছে। অধিকাংশ পরিবারই খেয়ে না খেয়ে তাদের পৈতৃক এই পেশা ধরে রেখেছেন। মাটির তৈরীর জিনিসের আয় দিয়ে বাড়ি-ঘর মেরামত, মেয়ের বিয়ে দেওয়াসহ নানা রকম কাজ নির্ভর করে। মাটির জিনিস তৈরী করতে মাটিও ক্রয় করে আনতে হয়। বছরে অন্ত:ত ৪০-৫০ হাজার টাকার মাটি লাগে বলে জানায়। মেলা না থাকলেও ভ্যান গাড়ি নিয়ে ওইসব জিনিস বিক্রি করা হয়। সৌখিন লোকজন ছাড়া কেউ ওইসব ক্রয় করতে চান না বলে জানায়।

এ শিল্পের সাথে জড়িতদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, একটা সময় ছিল যখন কিনা মাটির তৈরি জিনিসপত্রের প্রচুর চাহিদা এবং কদর ছিল। সাংসারিক কাজে সবাই মাটির হাড়ি পাতিল তথা মাটির তৈরী সামগ্রী ব্যবহার করতো। কিন্তু যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথেই বদলে গেছে মানুষের রুচিবোধ এবং চাহিদা। মানুষ এখন আর মাটির তৈরি সামগ্রীর প্রতি আগ্রহী নয়। বর্তমানে দুঃখ-কষ্টের মাঝে তাদের দিন কাটলেও এখনও তারা এখনও স্বপ্ন দেখেন কোনো একদিন কদর বাড়বে মাটির পণ্যের।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুমানা আক্তার বলেন, ঐতিহ্যবাহী অনেক শিল্প আমাদের এই উপজেলায় বিদ্যমান রয়েছে। তার মধ্যে মৃৎশিল্প একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। যেটি এক সময় অনেক নাম ছিল। বর্তমানে তারা অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে রয়েছে বাজারে প্লাস্টিক সামগ্রীর কারণে। আমার চেষ্টা করবো যাতে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি ধ্বংসের পথে না চলে যায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads