• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

সারা দেশ

মৃত্যুর আগে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখে যেতে চান ভাষা সৈনিক মিয়া মতিন

  • আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

ভাষা সৈনিক মিয়া মতিন। বয়স প্রায় ৯০ ছুঁই ছুুঁই। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ ইউনিয়নের টনকী গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। মিয়া মতিন ভাষা আন্দোলনের সময় বিভিন্ন মিটিং মিছিলে স্বক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে নেতৃত্ব দিলেও তিনি এখনও ভাষা সৈনিক হিসেবে সরকারি গেজেটেড স্বীকৃতি পাননি। তবে গত কয়েক বছর ধরেএকুশে ২১ ফেব্রুয়ারি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ভাষা সৈনিক হিসেবে সম্মান দেখানো হলেও সরকারি কাগজপত্রে ভাষা সৈনিক হিসেবে কোন স্বীকৃতি না পাওয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা। মায়ের ভাষার অধিকার এবং সম্মান রক্ষায় যারা ভাষা আন্দোলন করেছেন তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের মত ‘ভাষা সৈনিক’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা দাবি জানায়।

তারা বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের যদি সরকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, মর্যাদা, ভাতা দিতে পারে তাহলে ভাষা সৈনিকদের কেন তা দিতে পারবে না? ভাষা সৈনিকদের তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক।

ভাষা সৈনিক মিয়া মতিন টনকী গ্রামের মুত হাসিম ভূইয়ার ছেলে। তার ৪ ভাই ১ বোনের মধ্যে মিয়া মতিন ছিলেন সবার বড়। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মিয়া মতিন বলেন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ১৬ থেকে ১৭ বছরের যুবক। তখন তিনি উপজেলার মোগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।

বিদ্যালয়ে পড়ার সময় উর্দু ভাষা সকল ধর্মের ছাত্রদের বাধ্যতামূলক ছিল। উর্দু ভাষা শিখতে প্রচন্ড চাপ প্রয়োক করা হতো। এরপর থেকে উর্দু ভাষার প্রতি ঘৃণা জন্মে ছাত্রদের। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন।

মিয়া মতিন বলেন, ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কিছু রাজনৈতিক কর্মী ওই বিদ্যালয়ে এসে সবার কাছে ভাষা আন্দোলনের গুরত্ব তুলে ধরেন এবং আন্দোলনে যোগ দিতে শিক্ষার্থীদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন। শিক্ষকরাও আমাদের এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে আন্দোলনে অংশ নিতে বলেন। এরপর থেকে শিক্ষকদের উৎসাহে সহপাঠীদের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য বোঝানো শুরু করি আমরা। পাশাপাশি ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সফল করতে স্কুলের আটজন শিক্ষার্থীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় । এরমধ্যে তিনিও ছিলেন। প্রস্তুতি হিসাবে চাটাই কেটে বানানো হয় শ দুয়েক প্লাকার্ড। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যতীন্দ্র সরকার এসবের জন্য অর্থের জোগান দেন। স্কুলের করণিক বীরেন্দ্র ভট্টাচার্যসহ কয়েকজন মিলে প্ল্যাকার্ডে বিভিন্ন শ্লোগান লেখেন। এর মধ্যে ছিল ‘উর্দু ভাষায় লাথি মার, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চালু কর’, ‘রাষ্ট্রভাষা চাই’, ‘আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা’। পাঁচ দিনের প্রস্তুতি শেষে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশাল গণবিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। সকাল ১০টার দিকে মোগড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ভাষা আন্দোলনের মিছিল বের হয়। বিদ্যালয়ের ৮০০-এর মতো শিক্ষার্থীর প্রায় সবাই এতে অংশ নেয়। শিক্ষক-কর্মচারীরাও যোগ দেন আন্দোলনে। আমি ছিলাম মিছিলের অগ্রভাগে। মূলত বিদ্যালয় কেন্দ্রিক আন্দোলন হলেও মিছিল বের হওয়ার পর এলাকার শত শত মানুষ এতে যোগ দেয়। একপর্যায়ে তা গণবিক্ষোভ কর্মসূচিতে পরিণত হয়। মিছিলটি মোগড়াবাজার, রেলওয়ে স্টেশনসহ আশপাশ এলাকা প্রদক্ষিণ করে। মোগড়াবাজার এলাকায় আয়োজিত সমাবেশে আমিসহ রাজু সাহা, চনু সাহা, আবুল হাসেম, আব্দুল মালেক, অরুণ দাস প্রমুখ বক্তব্য দেন।

সমাবেশ থেকে জানানো হয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি মানা না হলে আন্দোলন আরো বেগবান করে তোলা হবে। ওই দিনের কর্মসূচির পর কিভাবে কী করা যায়, তা নিয়ে চিন্তভাবনা চলছিল। এরই মধ্যে আমরা যাঁরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি, তাঁদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয় তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার। ওই সরকারের মন্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার টি আলী আখাউড়ার আব্দুল মজিদ, আব্দুর রশিদ, মালেক খাদেমকে নির্দেশ দেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে থানায় জমা দিতে। তালিকা পেয়ে পুলিশ অভিযান শুরু করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে আমাদের টনকীর বাড়িতে এসে পুলিশ আমার নাম ধরে কোথায় আছি জানতে চায়। পরে আমাকে পেয়ে তারা ধরে নিয়ে যায়। তবে পুলিশ আমার সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করেনি। শুধু বলেছে আন্দোলন করায় সরকারের নির্দেশে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমিসহ আখাউড়ার আলী আজ্জম চৌধুরী, কসবার সুলতান খান, অহিদুজ্জামান ও অমল ঘোষকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। জেলখানায় বসেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হতো।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিজেশ্বরের আব্দুল মালেক, শাহবাজপুরের রবি নাগসহ আরো অনেকে আমাদের আন্দোলনের কৌশল শেখাতেন। বাংলা ভাষার জন্য তারা অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। কিন্তু আজ ও তার কোন স্বীকৃতি না পাওয়ায় অনেক কষ্ট বুকে চাপা পড়ে আছে।

মিয়া মতিন বলেন মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য সব কিছু ছেড়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। দীর্ঘ দিন জেল খেটেছেন। কিন্তু এতো কষ্ট করার পরেও ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কোনো সরকারি স্বীকৃতি আজও পাননি। তবে সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া কিছু উপহারের কথা আজও মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধেও তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছন। তারও স্বীকৃতি মেলেনি বলে জানালেন মিয়া মতিন। তিনি বলেন মৃত্যুর আগে যদি সরকারি স্বীকৃতি দেখে যেতে পারতাম তাহলে আত্মা শান্তি পেতো।

মিয়া মতিনের ২ ছেলে ৭ মেয়ের মধ্যে ২ মেয়ে মারা গেছে। এরমধ্যে ১ ছেলে প্রবাসে রয়েছে। ২ মেয়ে পড়াশুনা করছে। ওই ২ মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হলেও কেউ সরকারি কোন চাকরি পাননি । বাড়ির জায়গা আর সামান্য কৃষি জমি ছাড়া কিছুই নেই তাদের। বর্তমানে তার কোন আয়ের উৎস না থাকায় সংসার চালাতে অনেকটাই হিমসিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন বলেন, আমি আমার ছেলে মেয়েদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে ভাষা সৈনিকের সন্তান হিসেবে চিনে এটা আমার বড় পাওনা । সরকার যদি আনুষ্ঠানিকভাবে ভাষা সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলে আমার জীবনটা পূর্ণ হবে আমার আর কিছু চাওয়া পাওয়া থাকবে না।

ভাষা সৈনিক মিয়া মতিনের ছেলে আব্দুল বাতেন বলেন, আমার পিতা খুব সহজ সরল মানুষ জীবনে কখনো অন্যায় অবিচারের কাছে মাথানত করেনি। দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন । আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট দাবি জানায় তাকে যেন ভাষা সৈনিক হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads