• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সারা দেশ

গাছ পাগল মাওলার অনন্য দৃষ্টান্ত

  • কাজী মফিকুল ইসলাম, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
  • প্রকাশিত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২

মো: মাওলা মিয়া। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। গাছের প্রতি রয়েছে তার অগাত ভালো বাসা। সেই ভালোবাসা থেকে বৃক্ষপ্রেমী এই মানুষটি গাছের পেছনে ছুটছেন ৩০ বছর ধরে। প্রকৃতিকে শীতল করতে এ পযর্ন্ত তিনি ২৫ হাজারেরও বেশী বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন। পরিবশে রক্ষায় তার এই কাজ এলাকায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের মোগড়া এলাকার মৃত মুতি মিয়ার ছেলে গাছ পাগল মাওলা মিয়া। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি বিগত ৩০ বছরে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম, কবরস্থান, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, সরকারি অফিস, হাট-বাজার, বিভিন্ন রাস্তাঘাট, মোড়, ঈদগাহ মাঠ ও সরকারি খালি জায়গায় যেখানে সুবিধা পেয়েছেন সেখানেই গাছ লাগিয়েছেন। তার লাগানো গাছের মধ্যে কৃষ্ণচূড়া, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, মেহগনি, কদবেল, চালতে, আমড়া, জামরুল,বকুল ফুলের গাছও আছে। তার লাগানো ওইসব গাছের মধ্যে শত শত মানুষ পশু পাখি আশ্রয় নিচ্ছে। তবে গাছ লাগানোকে তিনি সন্তান জন্ম দেওয়া ও লালন পালনের মতো মনে করেন। টাকার জন্য নয় একমাত্র ভালোবাসার জন্য নিরলসভাবে এ কাজ করে যাচ্ছেন বৃক্ষপ্রেমী মাওলা মিয়া।
তবে তিনি গাছ লাগিয়েই থেমে থাকেন নি। গাছের গোড়ায় পানি দেনওয়ার পাশাপাশি করছেন রক্ষনাবেক্ষনও। যদি কোন গাছ মরে যায় তাহলে পুনরায় নতুন গাছ রোপনের ও ব্যবস্থা তিনি করছেন। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো বিদেশি বা দ্রুত বর্ধনশীল গাছ তিনি রোপন করেন না।

মাওলা অতি দরিদ্র ঘরের সন্তান হওয়ায় প্রাথমিকেই থেমে যায় তার শিক্ষাজীবন । তাছাড়া ছোট বেলায় তার বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারে তার হাল ধরতে হয়। পাশাপাশি শুরু হয় তার গাছ লাগানো। বাড়ির অদূরে দরুইন শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধিতে সর্বপ্রথম কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। সেখানে আজও বেশ কয়েকটি বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ রয়েছে যা পথিকের ছায়া দিয়ে চলছে। আর এই কাজ করে আসছেন জমি বর্গাচাষ কিংবা দৈনিক মজুরিতে কাজ করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে ২৫ কি:মি: দুরে মোগড়া গ্রাম। সামান্য এগুলেই ভারত সীমান্ত। তবে এই সীমান্তের ২০-২৫ কি:মি: এলাকায় বেশীভাগ জনগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় লাগানো রয়েছে তার গাছ। গাছ লাগানোর নেশায় তার সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। তিনি এখনও বিয়ে করেন নি। সেই যে শুরু আজ পর্যন্ত চলছে তার গাছ লাগানোর কাজ। টানা ৩০ বছর ধরে ২৫ হাজারের উপর নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন। তিনি যেখানে সুবিধা পাচ্ছেন সেখানেই গাছ লাগিয়ে আসছেন। তিনি আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লাার বিভিন্ন স্থানে ওইসব গাছ লাগিয়েছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গাছের যে কী পরিমান গুনাগুন রয়েছে তা যেন বলার অপেক্ষা রাখে না। গাছ আমাদের যেমন অক্সিজেন দেয়, পাশাপাশি ফল দেয়, কাঠ দেয়, ঔষধি গাছ থেকে ঔষধসহ বিভিন্ন গাছ থেকে আমরা পাচ্ছি সূতা। আমাদের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানসহ আমাদের গাছের কোন বিকল্প নেই।

সরেজমিনে মোগড়া উচ্চ বিদ্যালয়, মোগড়া বাজার, শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোস্তফা কামালের সমাধি, গঙ্গাসাগর গণকবর, টনকি দাখিল মদরাসা, আখাউড়া-কসবা সড়ক, ধাতুরপহেলা, পৌর শহরের দেবগ্রাম, শহীদ স্মৃতি ডিগ্রী কলেজ, হাওড়া বাধসহ বিভিন্ন এলাকায় গেলেই চোখে পড়বে তার লাগানো সারি সারি গাছ। ওইসব গাছের পেছনে শ্রম এবং নিয়মিত সময় দিতে আসছেন।

মাওলা বলেন, ছোট বেলায় মাঠে গরু চড়াতে গিয়ে প্রখর রোদে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। মাঠে গাছ গাছালি না থাকায় কোথাও একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কোন ছায়া মিলত না। প্রখর রোদে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতেন এখানে যদি একটি ছায়াবৃক্ষ থাকতো তাহলে কোন কষ্ট হতো না। সেই ভাবনা থেকে শুরু হয় তার গাছ লাগানো।

এরপর থেকে এলাকার জনগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গাছ লাগাতে শুরু করেন। শুধু গাছ লাগানো নয় কি ভাবে গাছকে বাঁচানো যায় সে চিন্তা ও তার রয়েছে। গাছ রক্ষার জন্য বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি নেন অভিনব কৌশলও। গাছ লাগানোর পর দুরন্ত শিশুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাদের মাঝে বাতাসা কিংবা সন্দেশ বিতরণ করছেন।

তিনি বলেন শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোস্তফা কামালের সমাধি,গঙ্গাসাগর ৩৩ মুক্তিযোদ্ধার গণকবর, মোগড়া উচ্চ বিদ্যালয়, মোগড়া বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর, সুহিলপুর, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিজ হাতে গাছ লাগিয়েছেন।

সময় সুযোগ হলে এসব গাছ প্রায় সময় দেখে আসেন। এগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর যত্ন করেন। যখন দেখেন গাছগুলো ছায়া দিচ্ছে পথচারীসহ শতশত মানুষকে তখন তিনি অনেক খুশি হন এবং আনন্দ পান।

তিনি আরও বলেন, বাড়িতে কোন স্বজন এলে কেউ প্রবাসে গেলে, কিংবা কোন ভালো সংবাদ নিয়ে আসলে তাকে উপহার দেন গাছের চারা।

মাওলা বলেন বাকি জীবনটাও তিনি গাছ লাগিয়ে পার করে দিতে চান। তিনি যখন দেখতে পান গাছের ছায়াতলে মানুষ বিশ্রাম নিচ্ছে পাখিরা গাছের ফল খাচ্ছে এগুলো দেখলে তার মন ভালো হয়ে যায় বলে জানায়।

তিনি বলেন বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব চারা সংগ্রহ করা হয়। চারা লাগানোর পর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরেও দেন। চারার গোড়ায় মাটি দেন। এরপর কয়েকদিন চারায় পানি দেন।

স্থানীয় বিল্লাল আহমেদ জানায়, মাওলা একজন গাছ পাগল মানুষ। এমন কোন জায়গা নেই যেখানে তার গাছ নেই। এ উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার গাছ রয়েছে। লোকজন মাওলার গাছের ছায়ার নিচে বসে আনন্দ পান। পাখিদেরও একটি আবাসস্থল হয়েছে। সে খুবই গরিব লোক। দিনে কাজ করে যে টাকা মজুরি পান বেশীভাগই গাছের তলে দিয়ে দেন।

সাহারাজ মিয়া বলেন, দেশের জনসংখ্যার ভারসাম্যের জন্য যে বনায়ন প্রয়োজন সে তুলনায় হচ্ছে না। নিজের চেষ্টায় দীর্ঘ বছর ধরে মাওলা বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগিয়ে আসছেন। মাওলার ফলজ গাছের ফল একদিকে যেমন মানুষ খাচ্ছে আবার পাখিদেরও খাদ্যের চাহিদা মিটছে। নিঃস্বার্থ এই বৃক্ষপ্রেমীকে অভিনন্দন জানান।

মোগড়া ইউপি চেয়ারম্যান মো: আব্দুল মতিন বলেন মাওলা একজন সাদা মনের মানুষ। এ মানুষটি অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করলেও দীর্ঘ বছর ধরে পরিবেশ রক্ষায় নিয়মিত গাছ লাগিয়ে এলাকায় এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন । তিনি শুধু গাছই লাগান না, এর পরিচর্যাও করেন। তিনি মাওলার এ কাজে সহযোগিতা করার জন্য সমাজের বিত্তবান ও হৃদয়বান মানুষদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা বেগম বলেন, মহৎ কাজ করার জন্য মহৎ মানুষের প্রয়োজন যা মাওলার মধ্যে এই গুনটি রয়েছে। তার এই মহৎ উদ্যোগ সফল হওক। সরকারি কোন সহায়তা থাকলে কিংবা আমাদের যদি কোন ধরনের বৃক্ষরোপন কর্মসূচি থাকে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে অবশ্যই মাওলা মিয়াকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করব।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads