• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
আখাউড়ায় বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ

প্রতীকী ছবি

সারা দেশ

দুই বছরে বিবাহ বিচ্ছেদ ৩৮৫টি

আখাউড়ায় বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ

  • কাজী মফিকুল ইসলাম, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
  • প্রকাশিত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

সাধারণত আমাদের দেশে বিয়ে শাদী কেউ ভালোবেসে আবার কেউ পরিবারের সিদ্ধান্তসহ নানা কারণে করে থাকেন। বিয়ের পর শুরু হয় তাদের সংসারের পরশ পাথরের গল্প। তবে বুক ভরা আশা আর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘর বাঁধলেও সর্বক্ষেত্রে ধরা দিচ্ছেনা সুখ পাখি। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় সংসারের বন্ধন যেন ক্রমশই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ভালোলাগা, ভালোবাসা আর সংসারের মায়া মমতা ও কমে যাচ্ছে । ফলে বাড়ছে কলহ আর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটনা।

এরইমধ্যে ব্রাাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় গত দুই বছরে অন্ত:ত ৩৮৫টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। মাদকাসক্ত, পরকীয়া, বাল্যবিবাহ, যৌতুক দাবী, স্বামী প্রবাসে থাকাসহ নানা কারণে এসব বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে।

বিয়ের পর ফুটফুটে সন্তান, সুন্দর সংসার ও মধুর সম্পর্কের স্মৃতি কোনো কিছুই যেন আটকাতে পারছে না এ বিচ্ছেদ। পিতা-মাতা নিজ সন্তানের কথা চিন্তা না করে শুধু তাদের মতকে প্রাধান্য দিয়ে দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছে।

উপজেলা কাজী অফিস-সূত্রে জানা গেছে, ১টি পৌরসভাসহ উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ৭টি নিকাহ নিবন্ধনের কার্যালয় (কাজী অফিস) রয়েছে। এ উপজেলায় গত দুই বছরে ১ হাজার ৮২১টি বিয়ে হয়। এরমধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে ৩৮৫টি। স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে ১৭৭টি, আর স্বামীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদ হয়েছে মাত্র ৩২টি। এর বাইরে দু’জনের সমঝোতায় বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে ১৭৫টি।

উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নে গত দুই বছরে বিয়ে হয়েছে ২৩৩টি, আর বিচ্ছেদ হয়েছে ৪৮টি, উত্তর ইউনিয়নে বিয়ে হয়েছে ১৯০টি, বিচ্ছেদ ৪৩টি, মোগড়া ইউনিয়নে বিয়ে হয়েছে ২৯৬টি, বিচ্ছেদ ১১৫টি, মনিয়ন্দ ইউনিয়নে বিয়ে হয়েছে ৩৪০টি, বিচ্ছেদ ৫৬টি ও ধরখার ইউনিয়নে বিয়ে হয়েছে ৩২৯টি, বিচ্ছেদ ৫৮টি। পৌরসভার দুইটি কার্যালয়ে বিয়ে হয়েছে ৪৩৩টি আর বিচ্ছেদ হয়েছ ৬৫টি। বিচ্ছেদ চাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা রয়েছে বেশি। বছরে যে পরিমাণ তালাকের আবেদন করা হয় তার গড় ৮০ শতাংশই স্ত্রীদের। স্বামীদের আবেদন খুবই কম।

দিন দিন বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভেঙে যাচ্ছে সংসার ও পারিবারিক বন্ধন। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিশু সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবন ও।

স্থানীয় সচেতন লোকজনরা জানায়, বাল্যবিয়ে, স্ত্রী-স্বামী উভয়ের উদাসীনতা, জোর করে বিয়ে, স্বামী মাদকাসক্ত, শ্বশুর-শাশুড়ির নির্যাতন, আর্থিক সমস্যা, স্ত্রীকে যৌতুকের জন্য চাপ প্রয়োগ ও স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের কারণেই বাড়ছে এসব বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা। তবে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর যদি একে অপরের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকে, অথবা বিনয়ী মানসিকতা থাকেন, তাহলেই বিয়ে বিচ্ছেদের হার কমে আসবে বলে তাদের ধারণা।

শিউলি আক্তার নামে এক গৃহবধূ (৩০) বলেন, গত তিন বছর আগে পরিবারের ইচ্ছায় প্রবাসী ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়। সংসারে তার একটি ছেলে রয়েছে। বাপের বাড়ি যাওয়া কিংবা আত্মীয় স্বজনের সাথে কথা বলা তার স্বামী সহ পরিবারের লোকজনরা তেমন পছন্দ করে না। কারণে অকারণে আমাকে তারা সন্দেহ করে। এখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ছেলেকে রেখে শেষ পযর্ন্ত বাধ্য হয়ে আমাকে তালাক নিতে হয়েছে।

ফারিয়া আক্তার লিজা বলেন, পরিবারের পছন্দে গত ৪ বছর আগে তার বিয়ে হয়। তাদের কোন সন্তান হয়নি। তার স্বামী একটি কোম্পানিতে চাকরি করলেও মাদকাসক্তের কারণে চাকরি বেশী দিন থাকেনি। এরপর সে একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে শুরু করে। সে বেশী ভাগ সময় নেশা করে বাড়ি ফিরতো। বহু চেষ্টা করেও তাকে ওই পথ থেকে ফিরিয়ে আনা যায় নি। তাছাড়া পরিবারের লোকজনরাও আমার সাথে সব সময় খারাপ আচরণ করতো। সংসারে নিয়মিত ঝগড়া লেগে থাকতো। এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে আমাকে তালাক নিতে হয়েছে।

বিলকিস আক্তার (২৫) বলেন,পারিবারিক সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়। এরই মধ্যে তাদের একটি মেয়ে সন্তান হয়েছে । বিয়ের পর থেকে সে উদাসীনভাব লক্ষ্য করা যায়। সব সময় মাঝ রাতে বাড়ি ফিরে আসতো। নিয়মিত মাদক সেবন করতো। পরিবারের অন্য সদস্যরা সামান্য কিছুতেই আমার সাথে ঝগড়া লেগে থাকতো। তার স্বামীও পরিবারের লোকজনকে বেশি গুরুত্ব দিতো।

তিনি আরো বলেন একটি মেয়ে কখনো সামান্য কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ চান না। যখন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সীমা অতিক্রম হয়ে যায়, তখনই এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতে হয়। আমি সেটাই করতে বাধ্য হয়েছি।

লিজা আক্তার বলেন, গত প্রায় ৫ বছর আগে সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এরমধ্যে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে। বিয়ের পর পরই তার স্বামী মাদকাসক্ত হয়ে অনেকটাই সংসারের প্রতি উদাসিন হয়ে উঠে। কিন্তু স্বামীর অস্বাভাবিক আচরণ কোন ভাবেই মেনে নিতে না পেরে অবশেষে তাকে তালাক নিতে হয়েছে।

প্রবাসী মো: মিলন মিয়া বলেন, গত প্রায় ১ বছর আগে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার স্ত্রীর বেশীভাগ সময় মোবাইল ফোনে অন্য ছেলের সাথে কথা বলে সময় কাটাতো। সামান্য বিষয় নিয়ে সে সংসারে ঝগড়া করতো। বেশীভাগ সময় রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যায়। তাছাড়া সব সময় মা বাবাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে খারাপ আচরন করতো। অনেক চেষ্টা করে ও তাকে সংশোধন করতে না পেরে শেষ পযর্ন্ত তাকে ছাড়তে হয়েছে।

উপজেলা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) সমিতির সভাপতি মুফতি কাজী কেফায়েত উল্লাহ মাহমুদী বলেন, পরকীয়া, যৌতুক, অল্প বয়সে বিবাহ, ও মাদকের প্রভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের মাত্রা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বিয়ের পর নেশাগ্রস্ত স্বামীর প্রতি স্ত্রী আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। নেশায় আক্রান্ত মানুষ শারীরিকভাবেও ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে ওঠে। সংগত কারণে একজন নারী ওই পুরুষের কাছে জীবন ও সংসারের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন না।

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রওনক ফারজানা বলেন, একটা সময় নারীরা নির্যাতনের বিষয়টি সহ্য করতেন। এখন আর আগের মতো কেউ সেটা সহ্য করতে চান না। কারণ, নারীরা আগের থেকে বেশি সচেতন হয়েছে। আয় রোজগার করতে শিখায় স্বামীদের ওপর নির্ভরশীলতাও কমেছে। তিনি আরো বলেন এ উপজেলায় প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। অভিভাবকরা অল্প বয়সেই মেয়েদের প্রবাসী ছেলেদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। যার ফলে তাদের মধ্যে তেমন বোঝাপড়া হয়ে না উঠায় দুই পরিবারে ফাটল ধরে। তবে বিয়ে বিচ্ছেদের বিষয় তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে একটু চিন্তা করেই সামনে এগোনো উচিত। তবেই বিয়ে বিচ্ছেদের হার কমবে বলে আমি মনে করি।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার অংগ্যজাই মারমা মনে করেন, বর্তমান সময়ে বিয়ে বিচ্ছেদের মূল সমস্যা হলো, উভয়ের মধ্যে ত্যাগের-সমঝোতা ও বিশ্বাসের বিষয়টি। তাছাড়া বাল্যবিবাহ, পরকীয়া, স্বামীর মাদকাসক্তির করণে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটছে। এটি কমাতে হলে আগে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে হবে।

তিনি বলেন, ‘বিয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে। বাল্যবিবাহ যেন না হয় সেজন্য উপজেলা প্রশাসন খুবই তৎপর রয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads