• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯
পাকিস্তানকে উড়িয়ে ফাইনালে বাংলাদেশ

বাতাসে ভেসে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় বল তালুবন্দী করার পর মাশরাফির অভিব্যক্তি

ছবি : ইন্টারনেট

ক্রিকেট

এশিয়া কাপ

পাকিস্তানকে উড়িয়ে ফাইনালে বাংলাদেশ

  • স্পোর্টস রিপোর্টার
  • প্রকাশিত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ম্যাচের আগে সাকিব আল হাসানকে হারানোর ধাক্কা সামলে দেখিয়ে দিল বাংলাদেশ। পাঁজরে ব্যথা সয়ে, বুকে টেপ পেঁচিয়ে, ক্র্যাম্প নিয়ে মুশফিকুর রহিম খেললেন আরেকটি অসাধারণ ইনিংস। অতিমানবীয় ক্যাচ নিয়ে আর অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্বে দলকে তাতিয়ে দিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে, বাধার একেকটি দেয়াল গুঁড়িয়ে বাংলাদেশ উঠল ফাইনালে। বুধবার আবুধাবির লড়াইয়ে পাকিস্তানকে ৩৭ রানে হারিয়ে বাংলাদেশ পা রাখল ফাইনালের মঞ্চে। ম্যাচ সেরা হয়েছেন মুশফিকুর রহিম। শুক্রবার দুবাইয়ের ফাইনালে আগে থেকেই অপেক্ষায় ভারত। এবার নিয়ে গত চার এশিয়া কাপের তিনটিতেই ফাইনালে উঠল বাংলাদেশ। তবে গত তিনটি আসর ছিল দেশের মাটিতে। এবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের কঠিন কন্ডিশন ও চোট-আঘাতের অসংখ্য ছোবল সামলে ফাইনাল।

টপ অর্ডারের ব্যাটিং ব্যর্থতার ধ্বংসস্তুপ থেকে বাংলাদেশকে টেনে তোলেন মুশফিক। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৯৯ রানে আউট হওয়ার হতাশায় পুড়েছেন। তবে মোহাম্মদ মিঠুনের সঙ্গে তার জুটির সৌজন্যেই বাংলাদেশ যেতে পারে ২৩৯ পর্যন্ত। রানটা লড়াই করার মতো হলেও ছিল না জয়ের মতো। মুস্তাফিজ-মিরাজদের দুর্দান্ত বোলিং সেটিকেই বানিয়ে ছাড়ল যথেষ্ট। পাকিস্তান থমকে গেছে ২০২ রানে।

দুর্দান্ত এই জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছে লড়াকু এক জুটি। চতুর্থ উইকেটে ১৪৪ রান তুলেছেন মুশফিক ও মিঠুন। পাকিস্তানের বিপক্ষে এই উইকেটে এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ।

প্রথম ম্যাচেও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৩১ রানের জুটি গড়েছিলেন এই দুজন। দুজনের জুটি বাঁধার গল্পটা এবারও একই। টপ অর্ডারের ব্যর্থতা। নাজমুল হোসেন শান্তর জায়গায় ফিরলেন সৌম্য সরকার, সাকিবের জায়গায় তিনে মুমিনুল হক। কিন্তু বদলাল না হতাশার চিত্র। হুট করেই পাওয়া সুযোগটা বড্ড হেলায় হারিয়েছেন সৌম্য সরকার। বাজে এক পুল শটে শূন্য রানেই ফিরেছেন টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা জুনাইদ খানেক উইকেট উপহার দিয়ে। তিন নম্বরে নিজেকে প্রমাণের সুবর্ণ একটি সুযোগ হারিয়েছেন মুমিনুল। বাঁহাতি পেসার শাহিন শাহ আফ্রিদিকে দৃষ্টিনন্দন ফ্লিকে চার মারার পরের বলেই বোল্ড ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে। পরের ওভারে জুনাইদের বলে লাইন মিস করে বোল্ড লিটন দাস। পঞ্চম ওভারে ১২ রানেই নেই ৩ উইকেট।

এই অবস্থায় যে কোনো দলেরই ধুঁকতে থাকার কথা। কিন্তু এশিয়া কাপে এটি বাংলাদেশের নিয়মিত চিত্র বলেই হয়তো খুব একটা বিচলিত মনে হয়নি মুশফিককে। ২২ গজে গিয়ে আবার শুরু করেছেন উদ্ধার পর্ব। সঙ্গী পেয়েছেন মিঠুনকে। পেসারদের সাবধানে খেলে দুজন আটকেছেন বিপর্যয়। পরে স্পিনারদের দারুণ খেলে বাড়িয়েছেন রান। দুজনের ব্যাটিং দাপটে এক সময় পাকিস্তানকে মনে হচ্ছিল মাঠে অসহায়। দুজনের জুটি এগিয়ে যায় দেড়শর পথে। ৬৬ বলে ফিফটি করেন মিঠুন, ৬৮ বলে মুশফিক।

কিন্তু পাকিস্তানকে ম্যাচে ফেরার পথ করে দেয় আবার এই জুটিই। প্রথম ম্যাচে ৬৩ করে যেভাবে আড়াআড়ি খেলে লাসিথ মালিঙ্গাকে উইকেট উপহার দিয়েছিলেন মিঠুন, সেটিরই যেন রিপ্লে দেখিয়ে ৬০ রানে উইকেট দিয়ে এলেন হাসান আলিকে। জুটি ভাঙলেও বাংলাদেশ তখন পেয়ে গেছে শক্ত ভিত। সেটি নড়বড়ে হয়ে যায় ইমরুল কায়েসের বিদায়ে। যে শাদাব খানের কথা ভেবে ছয়ে নামানো হয়েছে তাকে, সেই শাদাবের লেগ স্পিনেই ৯ রানে এলবিডব্লিউ ইমরুল।

আড়াইশ ছাড়ানোর আশা তখনো ছিল। মুশফিক সেঞ্চুরির পথে, মাহমুদউল্লাহ গিয়েই দারুণ খেলছিলেন। মুশফিকের বিদায় দিয়ে আবার পথ হারানোর শুরু। শাহিন শাহ আফ্রিদির অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে ৯৯ রানে কটবিহাইন্ড মুশফিক। পাকিস্তানিদের উল্লাসই বলে দিচ্ছিল, উইকেটটি কতটা জরুরি ছিল তাদের।

মিরাজ পারেননি সময়ের দাবি মেটাতে। বড় ধাক্কা হয়ে আসে শেষ দিকে রান তোলার জন্য যার দিকে তাকিয়ে থাকে দল সেই মাহমুদউল্লাহর বিদায়। ২৫ রানে বোল্ড জুনাইদকে আড়াআড়ি খেলে। মাশরাফি একটি ছক্কা মারলেও পারেননি শেষ করে আসতে। বাংলাদেশ অলআউট তাই শেষ ওভারের আগেই।

মোহাম্মদ আমিরের বাজে ফর্মে সুযোগ পাওয়া জুনাইদ ২০ রানে নিয়েছেন ৪ উইকেট। নতুন বলে তার সঙ্গী আফ্রিদির উইকেট দুটি। তবে শেষের হতাশাটুকু ঝেড়ে ফেলে বাংলাদেশ বোলিংয়ের নামে উজ্জীবিত হয়ে। শুরুতেই কাঁপিয়ে দেয় পাকিস্তানকে। বিপজ্জনক ফখর জামানের ডানা ছেটে দেন মেহেদী হাসান মিরাজ। নতুন বল পেয়ে মুস্তাফিজ নিজের প্রথম দুই ওভারে ফেরান বাবর আজম ও সরফরাজ আহমেদকে। পাকিস্তানের ৩ উইকেট নেই ১৮ রানে। ইমামকে এসব স্পর্শ করেনি। আর শোয়েব মালিকের তো বরাবরই এইসব পরিস্থিতি পছন্দ। এই দুজন মিলে আস্তে আস্তে কাটাতে থাকেন বিপর্যয়ের রেশ।

৬৭ রানের এই জুটি ভাঙে মাশরাফির জাদুকরী ক্যাচে। রুবেলের বলে মালিকের ফ্লিকে উড়ে এলো বল। শর্ট মিড উইকেটে উড়াল দিলেন অধিনায়ক। বাতাসে ভেসে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় তালুবন্দী করলেন বল! ডাইভিং ক্যাচ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক হাতে বল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মাশরাফি। স্তম্ভিত ব্যাটসম্যান মালিকও দাঁড়িয়ে ঠায়! সাকিবের বদলে মুমিনুলকে নেওয়ায় একাদশে একজন বোলার কম ছিল। পঞ্চম বোলারের কাজটা সেই সময় দারুণভাবে চালিয়ে নেন মাহমুদউল্লাহ ও সৌম্য সরকার। শুধু রানের গতিতেই বাধ দেননি দুজন, সৌম্য এনে দেন উইকেটও। তার মিডিয়াম পেসের বাউন্সারে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন শাদাব খান।

পাকিস্তানের রান তখন ৫ উইকেটে ৯৪। ম্যাচ বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নন ইমাম। এমনিতে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের জন্য পরিচিতি আসিফ আলি ঠাণ্ডা মাথায় দারুণ সঙ্গ দেন। এই দুজন আবার ম্যাচে ফিরিয়ে আনে পাকিস্তানকে। বাংলাদেশের জন্য বড় হতে থাকে শঙ্কার ছায়া। জুটি ভাঙতে মুস্তাফিজকে দ্বিতীয় স্পেলে ফেরান মাশরাফি। প্রথম বলেই আউট হতে পারতেন আসিফ। কিন্তু দুহাতে নেওয়ার মতো সহজ ক্যাচটি এক হাতে নিতে গিয়ে ফেলে দেন মাঠের বাইরে যাওয়া মুশফিকের জায়গায় উইকেটের পেছনে দাড়ানো লিটন। মনে হচ্ছিল সেটির খেসারত দিতে হবে দলকে। কিন্তু প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ হাতছাড়া করেননি লিটন। মিরাজের বলে দারুণ স্টাম্পিংয়ের শিকার ৩১ রান করা আসিফ। ভাঙে ৭১ রানের জুটি।

বাধা তখন কেবল ইমাম। মাশরাফি আচমকা বোলিংয়ে আনেন মাহমুদউল্লাহকে। কাজ হয়ে যায় জাদুমন্ত্রের মতো। জোরের ওপর করা বুদ্ধিদীপ্ত ডেলিভারিতে ৮২ রান করা ইমামের বিদায়। আরেকটি দারুণ স্টাম্পিংয়ে প্রায়শ্চিত্তের আরেক ধাপ পূরণ করেন লিটন। এরপর কেবল শেষের অপেক্ষা। শেষ দিকে আরও দুই শিকারে মুস্তাফিজ নিয়েছেন ৪ উইকেট। পাকিস্তানের শেষ জুটি অবশ্য টিকে গেল প্রায় ৫ ওভার। তাতে মুস্তাফিজের ৫ উইকেট হলো না। পাকিস্তানও অলআউট হলো না। তাতে খুব বেশি যায়-আসেনি। দেরিটুকুও তখন যেন ছিল আনন্দময়। এমন একটি জয়, এভাবে ফাইনালে ওঠার পথে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি মূহুর্তই যেন উৎসবমুখর উদযাপন!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ৪৮.৫ ওভারে ২৩৯ (লিটন ৬, শান্ত ০, মুমিনুল ৫, মুশফিক ৯৯, মিঠুন ৬০ ইমরুল ৯, মাহমুদউল্লাহ ২৫, মিরাজ ১২, মাশরাফি ১৩, রুবেল ১, মুস্তাফিজ ১*; জুনাইদ ৪/১৯, আফ্রিদি ২/৪৭, হাসান ২/৬০, নওয়াজ ০/৩৯, মালিক ০/১৪, শাদাব ১/৫২)।

পাকিস্তান: ৫০ ওভারে ২০২ (ফখর ১, ইমাম ৮৩, বাবর ১, সরফরাজ ১০, মালিক ৩০, শাদাব ৪, আসিফ ৩১, নওয়াজ ৮, হাসান ৮, ; মিরাজ ২/২৮, মুস্তাফিজ ৪/৪৩, মাশরাফি ০/৩৩, রুবেল ১/৩৮, মাহমুদউল্লাহ ১/৩৮, সৌম্য ১/১৯)।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads