• রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪২৯
বদলে যাওয়া প্রত্যয়ী তাসকিন

সংগৃহীত ছবি

ক্রিকেট

বদলে যাওয়া প্রত্যয়ী তাসকিন

  • প্রকাশিত ১০ মে ২০২১

একটা সময় চেহারার মধ্যে ছিল নায়ক নায়ক ভাব। অনেকে ডাকতও নায়ক বলে। এর মধ্যে মাশরাফি অন্যতম। সময়ের তালে সবকিছু পরিবর্তন হয়। তাসকিনও তার ব্যতিক্রম নন। সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা সফর যদি ধরা হয়, যেখানে ভিন্ন লুকে দেখা গেছে এই পেসারকে। নেই আগের মতো স্টাইলিশ চুল। চেহারায় কিউট কিউট ভাব। উল্টো দিকে এখন যে চেহারা, তাতে মনে হয় নিখাদ একজন শ্রমিক। আগুনে পোড়া স্বর্ণ। এই চেহারা এমনিতেই হয়নি। এর পেছনে আছে কঠিন অধ্যবসায়, পরিশ্রম আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। ২২ গজের লড়াইয়ে তাসকিন এখন ভিন্ন এক পেসার। বছর তিনেক আগের তাসকিনের সঙ্গে এখনকার তাসকিনের যেন অনেক দূরুত্ব। পার্থক্য পরিষ্কার বোঝা যায় বোলিংয়েও। সাড়ে তিন বছর পর টেস্টে সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ক্যান্ডির নিষ্প্রাণ উইকেটেও গতির ঝড় তুলে, বাউন্সার আর মাপা লাইন-লেংন্থে তাসকিন যেভাবে ভুগিয়েছেন ব্যাটসম্যানদের, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। নিজেকে বদলে ফেলার গল্পটা কেমন ছিল। কীভাবে সম্ভব হলো। বাংলাদেশের খবরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তা শুনিয়েছেন তাসকিন। জানিয়েছেন নতুন লক্ষ্য আর প্রতিজ্ঞার কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহমুদুন্নবী চঞ্চল  

প্রশ্ন : শ্রীলঙ্কা সিরিজ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কেমন?

তাসকিন : ব্যক্তিগতভাবে আগের চেয়ে ভালো করেছি, তবে আরো ভালো করার ছিল। প্রতিটা সিরিজই নতুন সুযোগ, প্রতিটা সিরিজই নতুন করে শুরু করতে চাই। একইভাবে প্রতিটা ম্যাচের ক্ষেত্রেও তাই। সব সময়ের মতো করেই বলতে হয়, নিজের সেরাটাই দিতে চাই সব সময়। সব মিলিয়ে ভালো হয়েছে। তবে খুব ভালো বা আহামরি কিছু হয়নি।    

প্রশ্ন : দীর্ঘদিন বাইরে থাকার পর দলে চান্স পাওয়া। প্রত্যাশা-প্রাপ্তির অবস্থান কেমন?

তাসকিন : প্রত্যাশা পূরণ হয়নি আসলে। আরেকটু ভালো করার আশা ছিল। কারণ স্বপ্ন বা আশা করা থেকে তো কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না। এটা আমার নিজের ইচ্ছা। নিজের ওপর প্রত্যাশা অনেক বেশিই থাকে সব সময়। এটার জন্যই কষ্ট করে যাচ্ছি। ভালো আশা করেছিলাম, তবে যেটা হয়েছে; সেটাতেও শুকরিয়া। এখানকার ভুল থেকে শেখার চেষ্টা করব, যেন সামনে এখান থেকে ২-১ শতাংশও উন্নতি হয়। উইকেট সব সময় বলে বলে নিতে পারব না, তবে চেষ্টা করাটাই আসল।

প্রশ্ন : লঙ্কা সফরের পারফরম্যান্স কিছুটা প্রশান্তি দিচ্ছে কি না?

তাসকিন : আমার মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড মাইন্ড ট্রেইনার সাবিদ ভাই (সাবিদ রায়হান) আর ফিটনেস ট্রেনার দেবুদা (বিসিবির চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী)। উনাদের সঙ্গে আমার সব সময় যোগাযোগ থাকে। কারণ এই দুটি বিষয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্যারিয়ারে। আমি এসব ঠিক রাখছি। পাশাপাশি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকা সাধারণ প্রক্রিয়াটা আমি ভালোভাবে মানছি যে, কীভাবে আমি আরেকটু ভালো করতে পারি। জীবনে কিছু না কিছু করার জন্য প্রতিদিনই একটা সুযোগ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে যেমন বোলিং করেছি, কিছুটা প্রশান্তি তো অবশ্যই আছে। দেশের হয়ে অনেক দিন পর টেস্ট খেললাম, এটাই একজন বোলারের জন্য অনেক বড় কিছু।

প্রশ্ন : সাদা বল ও লাল বলে কতটা পার্থক্য লাগছে?

তাসকিন : সাদা ও লাল বলে বোলিং করায় অবশ্যই পার্থক্য আছে। লাল বল অনেক কঠিন ক্রিকেট। সত্যিকারের ক্রিকেটই হচ্ছে টেস্ট। এটা তো আমরা সবাই জানি। হয়তো আমাদের দেশে অনেকে টেস্ট ক্রিকেটকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু এই ফরম্যাটই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট।

প্রশ্ন : এই তাসকিনকে তার দ্বিতীয় ভার্সন বলা যায়?

তাসকিন : হা হা, দ্বিতীয় ভার্সন কি না, এটা বলাটা কঠিন। তবে আগের থেকে সব ক্ষেত্রে অবশ্যই আমার পরিবর্তন হয়েছে, নিজেকে পরিবর্তন করেছি। আরো ভালো ভার্সন হতে হবে আমার লক্ষ্য অনুযায়ী। এখন যে অবস্থায় আছি, সেটা ঠিক আছে। তবে তৃপ্তি পেতে হলে নিজের আরো অনেক উন্নতি দরকার।

প্রশ্ন : ফিটনেস, বোলিং মিলিয়ে নিজেকে কোথায় দেখছেন?

তাসকিন : হ্যাঁ, এই পথটা ঠিক আছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ আমি আমার মাইন্ড ট্রেইনার, ফিটনেস ট্রেনার, সুজন স্যার, জাকি স্যারদের সঙ্গে কথা বলি নিয়মিতভাবে। তাদের মতেও আমি ঠিক পথে আছি, ভালো চলছে। তবে এই পথের অনেকটা পাড়ি দেওয়া বাকি এখনো। এই প্রক্রিয়াটা ধরে রাখতে হবে।

প্রশ্ন : আগের লকডাউনে নিজে নিজেই ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছেন, ওজন কমিয়েছেন বেশ। ওজন কমানোর সুফল মিলছে?

তাসকিন : ওজন কমানোর সাথে আপনার ফিটনেস ঠিক রাখাটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে ফিট ও শক্তিশালী থাকতে হবে। এটা নিয়ে বেশ আগে থেকেই কাজ করে আসছি। এখন করছি, সামনেও করে যাব।

প্রশ্ন : বোলিং থেকে শুরু করে শারীরিক গঠন, সব খানেই পরিবর্তন। কীভাবে?

তাসকিন : পুরো প্রক্রিয়াটা গত লকডাউনে শুরু হয়েছিল। তখন আমি আমার ফিটনেস ট্রেইনারের কাছে গিয়ে বললাম, আমাকে ট্রেনিং করান। আমাকে উনি বললেন, লকডাউনে সব বন্ধ। তা-ও আমি বললাম ‘সেফটি মেইনটেইন করে একটু করান। আপনি এখন যদি আমাকে ট্রেনিং না করান, তাহলে আমি ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যাব। কারণ আমি অফফর্ম, ইনজুরিতে আছি,অনেক স্ট্রাগল করছি।’ ওই সময় সাবিদ ভাই, দেবুদা; সবার সাপোর্ট আমি নিয়েছি। সাপোর্ট নিয়ে আমার কাজ শুরু করলাম। সব কিছু যেন সুন্দর মতো করা যায়, তা নিয়ে কাজ করেছি। এখনো একই প্রক্রিয়ায় কাজ করছি। আশা করি চালিয়ে যাব।

প্রশ্ন : ওটিস গিবসন ও জাকি স্যার?

তাসকিন : দুজনেরই অনেক অবদান আছে। জাকি স্যার আমাকে ছোটবেলা থেকেই চেনেন। আমাকে ছোট থাকা অবস্থায় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। দুজনই আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন সব ক্ষেত্রে। আমি তাদের প্রতি অবশ্যই অনেক কৃতজ্ঞ।

প্রশ্ন : কখন মনে হলো এভাবে হচ্ছে না; গতি বাড়াতে হবে, নিজেকে বদলাতে হবে?

তাসকিন : যখন দেখলাম দুই বছর আগে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, একেবারে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে ক্রিকেট ভক্ত, সবকিছুতে পরিবর্তন আসা শুরু হলো। নিজের মধ্যে যখন মনে হলো আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছি, তখনই মনে হয়েছে আমাকে বদলানো উচিত। এরপর মাঠ ও মাঠের বাইরে আমার সেরাটা দিয়েছি। ওভাবেই পরিকল্পনা করি। এর পর চেষ্টা, পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে ঠিক পথে ফেরাতে পেরেছি।

প্রশ্ন : আপনার চেহারায় হিরো হিরো একটা ভাব ছিল, যেটা এখন নেই। মিস করেন সেটা?

তাসকিন : আয়নার সামনে দাঁড়ালে হিরোর লুকটা মিস করি। সব মেনে কঠোর পরিশ্রম করলে মুখের অবস্থা তুলতুলে থাকে না। সহজ করে বললে চাপা ভেঙে চায়। তো লুক তো আর ইচ্ছে করে পরিবর্তন করিনি, হয়ে গেছে। চেহারা সুন্দর থাকুক, কেনা চায়। তবে কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়। আর আমি এটাই এখন উপভোগ করছি। কারণ আমার পরিচয় পেসার। এভাবেই থাকতে চাই।

প্রশ্ন : নিউজিল্যান্ড সফর নিয়ে যদি কিছু বলেন।

তাসকিন : ওয়ানডে সিরিজে হয়তো আমি সেভাবে উইকেট পাইনি, তবে বোলিং মোটামুটি ভালোই হয়েছিল। ওই সিরিজ দিয়েই তো আমার ফেরা। ওখানেই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আমার। হয়তো প্রত্যাশা মতো সব হয়নি, তবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। দুর্ভাগ্যবসত আমাদের দলের ফল ভালো হয়নি তবে আমি আগের চেয়ে বোলিংয়ে ভালো করেছি। আগে যে আরো তিনবার নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলাম, প্রতিবারের চেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করেছি বলে মনে হয়। 

প্রশ্ন : তাসকিনের বলে ক্যাচ পড়বেই। নিউজিল্যান্ডের পর শ্রীলঙ্কা সিরিজসহ আগেও এমন দেখা গেছে। ব্যাপারটি কীভাবে দেখেন?

তাসকিন : এই ব্যাপারটা একদমই আমার হাতে নেই। যেটা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেটা নিয়ে ভেবে কিছু হবে না। উল্টো হতাশা বাড়বে। ক্যাচ পড়লে আমি কোনো বাজে রিঅ্যাক্ট করি না। কারণ কেউ তো আর ইচ্ছা করে ক্যাচ ফেলে না। আমি বেশির ভাগ সময় স্বাভাবিক রিঅ্যাকশনই দিই।

প্রশ্ন : আপনার আইডল মাশরাফি। আপনার পরিবর্তনে তার কোনো উপদেশ বা টিপস ছিল কি না?

তাসকিন : মাশরাফি ভাই আমাদের সবার জন্য বড় এক অনুপ্রেরণার নাম। উনি যেভাবে ক্যারিয়ারে ফিরে এসেছেন বারবার, এটা যে কারো জন্য উদাহরণ, শুধু ক্রিকেটারদের জন্য নয়। প্রতিটা সিরিজের আগে বা পরে ভাইয়ের সাথে একবার হলেও কথা হয়। প্রশ্ন থাকে কেমন দেখলেন বা কোনটা উন্নতি করলে আরো ভালো হয়। কারণ মাশরাফি ভাইয়ের অধিনায়কত্বে আমি অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছি। উনি আমাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তাই সুযোগ হলেই ভাইয়ের সাথে কথা বলি। উনার সঙ্গে কথা বলতে পারাও অনেকের জন্য বড় শিক্ষার। 

প্রশ্ন : ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ এবার। প্রত্যাশা কেমন?

তাসকিন : আমাদের উইকেটের আচরণ একটু আলাদা থাকতে পারে। তবে ভারসাম্য তো একই, ভালো জায়গায় বল করতে হবে। আর ঘরের মাঠ হলে তো বেশি ভালো করার প্রত্যাশা সবারই থাকে। হোম গ্রাউন্ডে খেলা হবে, এটায় ভালো লাগছে। তবে প্রতিটা ম্যাচই কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের কন্ডিশনের মিল আছে। ওরা আমাদের মতো কন্ডিশনেই খেলে। ওদের জন্য স্পিনা বা পেস বোলিং খেলা যে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, তা কিন্তু নয়। উপমহাদেশের দলগুলো এখানে যেকোনো কিছু করতে পারে, এটা তো সবারই জানা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads