• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
কেন বাদ পড়লেন সাঈদ খোকন

সংগৃহীত ছবি

নির্বাচন

কেন বাদ পড়লেন সাঈদ খোকন

প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯

হঠাৎ আলোচনায় এসেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। গতকাল আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঘোষণা করেছে। শেষ পর্যন্ত বাদ পড়লেন সাঈদ খোকন। অবশ্য কয়েকদিনের আলোচনা থেকেই তার বাদপড়ার বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যদিও মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে ব্যাপক আবেগ প্রকাশ করে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কম, ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থতা ও বেফাঁস মন্তব্যে কপাল পুড়েছে সাঈদ খোকনের। তবে কিছু ক্ষেত্রে তিনি ইতিবাচক ধারার সূচনা করেছেন।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সাঈদ খোকনের কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। প্রথমত তিনি হকার উচ্ছেদের চেষ্টা করেছেন। হয়তো পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। কারণ এর সঙ্গে বড় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার। সেটি কতটা পেয়েছেন আমরা জানি না। দ্বিতীয়ত ঢাকার বিদ্যমান খেলার মাঠের উন্নয়নে কিছু কার্যক্রম তিনি হাতে নিয়েছিলেন। তবে সব এলাকায় সেটি করতে পারেননি।

এই নগর পরিকল্পনাবিদ মনে করেন, সাঈদ খোকন সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন ডেঙ্গু পরিস্থিতির কারণে। এটি যখন মহামারী আকার নেয়, তখন তিনি বিষয়টি স্বীকার করে নিতে পারতেন। কিন্তু সেটি না করে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিতর্কিত মন্তব্য করে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়েছেন। এটি সত্য, ডেঙ্গু পরিস্থিতির সামাল দেওয়া সিটি করপোরেশনের মেয়রের একার দায়িত্ব নয়। একা তিনি চাইলেও উন্নতি করতে পারতেন না। এর সঙ্গে আরো অনেক কর্তৃপক্ষ জড়িত।

নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকার উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঠিক মতো শেষ করতে পারেননি। অন্যদিকে, ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখিনি। তবে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়। সেটি কেবল আশ্বাসেই চলে গেছে।  

বিশ্লেষকরা বলছেন, পাঁচ বছর আগে নির্বাচনী ইশতেহারে পাঁচটি প্রধান সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। এর বাইরে আরো ১০টি প্রতিশ্রুতি ছিল সাঈদ খোকনের। প্রধান সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি। অন্যান্য প্রতিশ্রুতিরও বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়। তবে কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছেন, কাজ চলমান রয়েছে।

তারা বলছেন, নির্বাচনের আগে বর্তমান মেয়র এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যেগুলো সিটি করপোরেশনের এখতিয়ারের বাইরে। আবার এমন অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল যেগুলোর বাস্তবায়ন সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যেসব প্রতিশ্রুতি সরাসরি সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়নের কথা, সেগুলোতে মেয়র সফল হতে পারেননি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাঁচ বছর আগের পরিস্থিতিই ছিল জটিল। এই পাঁচ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা আরো বেড়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সমস্যা আরো বিস্তৃত হয়েছে। সাঈদ খোকনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো ছিল অবাস্তব। যানজটের মতো বৃহত্তর সমস্যা তাঁর পক্ষে একা নিরসন সম্ভব ছিল না।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল সর্বশেষ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন ‘পরিকল্পিত উন্নয়ন, সুযোগের সমতা, নিরাপদ ও দূষণমুক্ত আধুনিক ঢাকা’ শিরোনামে ইশতেহার ঘোষণা করেন। তাতে যানজট নিরসন, দূষণমুক্ত, নাব্য ও নিরাপদ বুড়িগঙ্গা, পানি-গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা, পরিচ্ছন্ন-দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর মহানগরী, দুর্নীতি সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

এর বাইরে সাঈদ খোকন আরো ১০টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল ডিজিটাল মহানগরী, সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ, বস্তি উন্নয়ন ও দলিত হরিজন সম্প্রদায়ের মানবিক মর্যাদা ও সুযোগের সমতা, আবাসন সমস্যা সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ, ঐতিহ্য সংরক্ষণ, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ, ক্রীড়া ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, কামরাঙ্গীরচরে নবগঠিত তিনটি ওয়ার্ডের উন্নয়ন ও নগর প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা।

সূত্রমতে, নগরবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারা, বিভিন্ন সময়ে বেফাঁস মন্তব্য, মশানিধনে ব্যর্থতা ও নগরবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে না পারা ইত্যাদি কারণে দলীয় মনোনয়ন পাননি খোকন। তবে সাঈদ খোকনের দাবি, তিনি কখনো কর্তব্যে অবহেলা করেননি।

গত ২৫ জুলাই রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এক অনুষ্ঠানে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাকে ‘গুজব’ বলে মন্তব্য করেছিলেন মেয়র খোকন। তিনি বলেন, ‘মশা নিয়ে রাজনীতি কাম্য নয়। সাড়ে তিন লাখ আক্রান্তের যে তথ্য এসেছে সেটি কাল্পনিক তথ্য। ছেলেধরা আর সাড়ে তিন লাখ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত একই সূত্রে গাঁথা।’ মেয়রের এমন মন্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ দলের ভেতরে সমালোচনার ঝড় ওঠে।’

এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর আজিমপুরের পার্ল হারবাল কমিউনিটি সেন্টারের পাশে কর্মী সমাবেশ ডাকে আওয়ামী লীগ। তার পাশেই মেয়র সাঈদ খোকন পাল্টা কর্মসূচি দেন। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়ায় কে বা কারা সমাবেশস্থলের সামনে সিটি করপোরেশনের ট্রাক ভর্তি করে ময়লা রেখে যায়। ওই ঘটনার জন্য মেয়র সাঈদ খোকনকেই দোষারোপ করা হয়। এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন খোকন। এ নিয়েও দলীয়ভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।

সাঈদ খোকন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ হানিফের ছেলে। তিনি পুরান ঢাকার অন্যতম ব্যক্তিত্ব মাজেদ সর্দারের নাতি। বাবা মোহাম্মদ হানিফের হাত ধরেই সাঈদ খোকন রাজনীতিতে নামেন। তিনি আওয়ামী লীগে নাম লেখান ১৯৮৭ সালে ওয়ার্ড শাখার আইনবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে। ১৯৯৯ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০৪ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন। সর্বশেষ তিনি মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে ছিলেন।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়ে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। ৬ মে তিনি মেয়র হিসেবে শপথ নেন।

যানজট পরিস্থিতি অসহনীয় হয়েছে : গত পাঁচ বছরে রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি আরো দুর্বিষহ হয়েছে। সিটি করপোরেশনে যানজট নিরসনে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। রিকশার নিবন্ধন নিতে হয় সিটি করপোরেশন থেকে। শহর দাপিয়ে বেড়ানো এসব অবৈধ রিকশা বন্ধে সিটি করপোরেশন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যানজটে ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর যানজটের কারণে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, অঙ্কের হিসাবে তা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।

দূষণের শীর্ষে এসেছে ঢাকা : অপরিচ্ছন্নতা, দূষণ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সাঈদ খোকন ঢাকার সমস্যা সঠিকভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। এসব সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে উদ্যোগ ছিল না বললেই চলে। কয়েক বছর ধরেই ঢাকার বায়ুমান খারাপ হচ্ছে। চলতি বছর একাধিকবার বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকার শীর্ষে উঠে আসে ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ডিসেম্বর মাসের বেশিরভাগ সময় ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকার শীর্ষ পাঁচে।

চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়নি : ফুটপাত দখল করে আড়াই লাখের বেশি হকার ব্যবসা করে। ফুটপাতে বসতে একজন হকারকে এলাকাভেদে ৫০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রায়ই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও বেশিরভাগ ফুটপাত দখলমুক্ত করা যায়নি। সিটি করপোরেশনের উদাসীনতা ও চাঁদাবাজদের দাপটে এই উদ্যোগ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে অভিযানের পরপরই সেখানে আবার বসে পড়ছেন হকাররা। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হকারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নগরীর পাঁচটি স্থানে ‘হলিডে মার্কেট’ চালুর উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে দুটি মার্কেট চালু হয়েছিল, এখন তাও বন্ধ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads